সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় সূচনা লগ্নে ব্যবসায়ের পরিসর ছিল অল্প ও সংকীর্ণ, তাই এর সাংগঠনিক রূপ ছিল সহজ, ছোট। যেমন—একমালিকানা, অংশীদারি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে শুরু হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলে শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পূর্বেকার কায়িকশ্রমের স্থান দখল করে নেয় যন্ত্রপাতি এবং শুরু হয় বৃহদায়তন উৎপাদনের পালা । এমতাবস্থায় ব্যবসায় সংগঠনের প্রাথমিক রূপ তথা একমালিকানা ব্যবসায় এবং অংশীদারি ব্যবসায়ের পক্ষে এদের কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে বৃহদায়তন পণ্যদ্রব্যাদির উৎপাদন ও বণ্টন কার্য পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলাতে যেয়ে অধিক মূলধন, সীমাবদ্ধ দায়, দক্ষ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা এবং চিরন্তন অস্তিত্বের সুবিধা নিয়ে যুগোপযোগী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের উদ্ভব ঘটে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা জানতে পারব—
সূত্র: ক্যামব্রিয়ান পাবলিকেশন্স
প্রকৃতিগতভাবেই কোম্পানি সংগঠন একটি লাভজনক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এর কৃত্রিম সত্তা, চিরন্তন অস্তিত্ব, নিজস্ব সীলমোহর, প্রভৃতি বিশেষ বৈশিষ্ট্য একে অন্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে পৃথক করেছে। নি েকোম্পানি সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়া হলো—
কোম্পানি হলো আইনসৃষ্ট একটি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশেষ প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি আইন যৌথ মূলধনী কোম্পানিকে একজন ব্যক্তির মত স্বতন্ত্র সত্তা দান করেছে। কোম্পানির এই সত্তা আইনগতভাবে স্বীকৃত। এই সত্তা বলে এটি নিজ নামে সর্বত্র পরিচিত এবং এই সত্তা নিয়ে কোম্পানি ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারে। যদিও কোম্পানির হাত-পা নেই, সে খেতে পারে না, ঘুমোতে পারে না তবু একে ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়, যাকে কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ আইনের চোখেই এটি একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তি, যা অদৃশ্য ও অস্পর্শনীয়। তবে রক্তমাংসের গড়া মানুষ বা ব্যক্তি না হলেও কোম্পানি একজন ব্যক্তির মতোই নিজ নামে তৃতীয় পক্ষের সাথে যেকোন ধরনের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে এবং অপরকেও চুক্তিতে আবদ্ধ করতে পারে। এটি নিজ নামে অন্যের বিরুদ্ধে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের এবং অপরেও কোম্পানির বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারে ।
আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি পৃথক ও চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন। কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাই একে চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession) দান করেছে। কোম্পানির সদস্যের অর্থাৎ মালিকের অস্তিত্বের সাথে এর অস্তিত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কোন কারণে কোম্পানির সদস্য পদ পরিবর্তন কিংবা সকল সদস্যের মৃত্যু ঘটলেও কোম্পানির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় না। এ প্রসঙ্গে সলোমান বনাম সলোমান এন্ড কোং লিঃ-এর মামলার রায়ে বলা হয় যে, কোম্পানি এর সদস্যদের থেকে পৃথক এবং এর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান ।
বর্তমানে ব্যাপক প্রচলিত, জনপ্রিয় ও বৃহৎ পরিসরে কার্যকরী ব্যবসায় সংগঠন হলো কোম্পানি সংগঠন। সাধারণ অর্থে, কয়েকজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় কোনো ব্যবসায় সংগঠন গঠন করলে তাকে কোম্পানি সংগঠন বলে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোম্পানি “কোম্পানি আইন ১৯৯৪” অনুসারে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে । কোম্পানি নিজ নামের সীলমোহরের চিরন্তন অস্তিত্বের ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী হয়ে থাকে। তাই ব্যাপকভাবে বলা যায় যে, কোম্পানি হলো আইন সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট, চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন সীমিত দায়বিশিষ্ট এমন একটি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যেখানে কিছু লোক মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যৌথভাবে মূলধন বিনিয়োগ করে।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২ (১) (ঘ) ধারা অনুযায়ী “কোম্পানি বলতে এ আইনের অধিনে গঠিত ও নিবন্ধিত কোম্পানি বা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বুঝায়।” ("Company means a company formed and registered under this Act of any existing.")
কোম্পানি সংগঠন বা কোম্পানি হলো আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তি সত্তার অধিকারী এমন এক ধরনের আধুনিক ও প্রচলিত ব্যবসায় সংগঠন যা অদৃশ্য, অস্পর্শনীয় অথচ চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী যার নিজস্ব নাম সীল মোহর দ্বারা পরিচিত ও পরিচালিত হয়। এই সংগঠন স্বেচ্ছায় যৌথভাবে শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মূলধন বিনিয়োগ করে এবং বিনিয়োগকৃত মূলধনের উপর মুনাফা ঘোষণা ও বণ্টন করে ।
বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায়ের জগতে কোম্পানি সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ব্যবসায় সংগঠন। এটি একটি আইন-সৃষ্ট যৌথ মালিকানার স্বেচ্ছামূলক ব্যবসায় সংগঠন, এর এমন বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে যা একে অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠন থেকে পৃথক সত্তার অধিকারী করেছে। কোম্পানি সংগঠনের এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. জটিল গঠন পদ্ধতি (Complicated formation): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট আইনানুগ আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়।
২. স্বেচ্ছামূলক সংস্থা (Voluntary association): যৌথ মূলধনী কোম্পানি একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যবসায় সংস্থা। মুনাফার উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যক্তির স্বেচ্ছাকৃত প্রচেষ্টায় কোম্পানি গঠিত হয়ে থাকে । যে কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানির মালিক হতে পারে, আবার কেউ ইচ্ছা করলেই শেয়ার হস্তান্তর করে সহজেই ব্যবসায় হতে বিদায় নিতে পারে ।
৩. বিপুল পুঁজি (Huge capital): বহু সংখ্যক ব্যক্তির সংগঠন বিধায় কোম্পানি তুলনামূলকভাবে অধিক মূলধন সংগ্রহ করতে পারে । এটি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রি করে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করে থাকে ।
৪. বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন (Large-scale enterprise): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে যৌথ মূলধনী কোম্পানি সমধিক পরিচিত। প্রচুর সদস্য সংখ্যা, ব্যাপক মূলধন সর্বক্ষেত্রেই কোম্পানি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
৫. লভ্যাংশ বণ্টন (Distribution of dividend): যৌথ মূলধনী কোম্পানির অর্জিত মুনাফার একটা নির্দিষ্ট অংশ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ার মালিকদের মধ্যে শেয়ারের আনুপাতিক হারে বণ্টিত হয়ে থাকে । কোম্পানির সাধারণ সভার অনুমোদনক্রমে পরিচালকগণ এই লভ্যাংশের পরিমাণ ঘোষণা করেন ৷
৬. করারোপ (Taxation): কোম্পানির ওপর ধার্য করের হার সাধারণত অধিক হয়ে থাকে। এর অর্জিত মুনাফার ওপর করারোপ করা হয়। আবার শেয়ার মালিকদের প্রাপ্ত লভ্যাংশের উপর কর প্রদান করতে হয় ।
৭. বিলোপসাধন (Dissolution): যৌথ মূলধনী কোম্পানির গঠন যেমন আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ তেমনি এর বিলোপসাধনের ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিকতা পালনের প্রয়োজন হয়। কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী এর বিলোপসাধন ঘটে। এ কারণে কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারগণ ইচ্ছা করলেই এর বিলোপসাধন করতে পারে না ।
৮. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Democratic management): যৌথ মূলধনী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল স্তরে গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসৃত হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের মাধ্যমে কোম্পানির পরিচালকগণ নির্বাচিত হয়ে থাকে এবং তাদের দ্বারা কোম্পানি পরিচালিত হয়। এছাড়া ব্যবসায়ের উল্লেখযোগ্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও শেয়ারহোল্ডারগণের ভোটের ফলাফলের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে।
১. আইন-সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান (Law-created concern): কোম্পানি আইন দ্বারা এ প্রতিষ্ঠান সৃষ্ট হয়। বাংলাদেশে যৌথ মূলধনী কোম্পানিসমূহ ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইন অনুযায়ী গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। উক্ত আইনের ২.১ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে যে, ”কোম্পানি বলতে এ আইনের অধীনে গঠিত এবং নিবন্ধনকৃত কোনো কোম্পানি বা কোনো বিদ্যমান কোম্পানিকে বোঝাবে।”
২. সদস্য সংখ্যা (Number of members) : কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এর সদস্য সংখ্যা ন্যূনতম ২ এবং সর্বাধিক ৫০ জনে সীমাবদ্ধ থাকে এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বেলায় সর্বনি সদস্য সংখ্যা ৭ এবং সর্বোচ্চ সংখ্যা কোম্পানির সংঘ-স্মারকে উল্লিখিত শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে ।
৩. পৃথক ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা (Seperate and aritificial entity): কোম্পানি একটি স্বতন্ত্র কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। এ কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা এর সদস্যদের সত্তা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আইন অনুযায়ী এটি কৃত্রিম ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে থাকে। এই আইনগত সত্তাবলে কোম্পানি নিজ নামে অন্যের সাথে যেমনি লেনদেন করতে পারে তেমনি মোকদ্দমাও দায়ের করতে পারে।
৪. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession): আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী এক কৃত্রিম ব্যক্তি। কোম্পানির সদস্য বা শেয়ার মালিকদের অস্তিত্বের উপর এ অস্তিত্ব নির্ভর করে না। কোম্পানির মালিকানা বা সদস্য পদের পরিবর্তনে এর অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না। কেবল কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোম্পানির বিলোপসাধন করা হলেই এর অস্তিত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে থাকে।
৫. সীমিত দায় (Limited liability): কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডারদের দায় সীমিত। একজন সদস্য যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার কিনবে ঠিক সে পরিমাণ অর্থের জন্যই তাকে দায়ী করা যেতে পারে-এর বেশি নয়। অর্থাৎ এর সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের মোট মূল্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে।
৬. বাধ্যতামূলক নিবন্ধন (Compulsory registration ) : যৌথ মূলধনী কোম্পানির নিবন্ধন আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। কোম্পানি আইন অনুসারে যৌথ মূলধনী কোম্পানিকে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে। নিবন্ধন ব্যতীত কোনো কোম্পানি গঠিত এবং পরিচালিত হতে পারে না ।
৭. সাধারণ সীলমোহর (Common seal): প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব নামাঙ্কিত একটি সাধারণ সীলমোহর থাকে। কোম্পানির যাবতীয় দলিল-দস্তাবেজ ও কাগজপত্রে এ সীলমোহর ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। এ সীলমোহরের মাধ্যমেই যৌথ মূলধনী কোম্পানি স্বতন্ত্র ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা নিয়ে জনসাধারণের নিকট পরিচিতি লাভ করে ।
৮. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability of shares): যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। শেয়ারের হস্তান্তরের সাথে সাথে কোম্পানির মালিকানায়ও পরিবর্তন সূচিত হয়। অর্থাৎ শেয়ার হস্তান্তরের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়কারী কোম্পানির মালিক হন ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী বৃহদায়তন প্রকৃতির ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। যা কোম্পানি আইন এবং নিজস্ব স্মারকলিপি ও পরিমেল নিয়মাবলির আওতায় একটি স্বতন্ত্র ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে গঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে ।
একদিকে ব্যবসায় জগতে ব্যাপক উন্নয়ন অন্যদিকে একমালিকানা ও অংশীদারি ব্যবসায়ের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে নতুন সংগঠন কাঠামো কোম্পানি সংগঠনের উৎপত্তি ঘটে, পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় জগতে আরো ব্যাপক উন্নয়নের ফলে এর ব্যবসায়ের গতি প্রকৃতিতেও পরিবর্তন সূচিত হয়। যার ফলে কোম্পানির ধরনেও পার্থক্য ঘটে । নিম্নে কোম্পানির প্রকারভেদ বিস্তারিত আলোচিত হলো—
সদস্যদের দায়ের প্রকৃতি অনুসারে এরূপ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়। দায়-এর প্রকৃতি অনুযায়ী কোম্পানি তিন প্রকার হতে পারে। যথা—
১. শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি (Companies limited by share): যে কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় শেয়ারের আংকিক মূল্য পর্যন্ত সীমিত থাকে, তাকে শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়বিশিষ্ট কোম্পানি বলে । যেমন-প্রাইভেট লিমিটেড ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি।
২. প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি (Companies limited by guarantee): যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পর্যন্ত দায় পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, তাদের প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানিতে যে সব সদস্য শেয়ার দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায় বহন করে, শেয়ারের অপরিশোধিত মূল্য পর্যন্ত তাদের দায় থাকে। শেয়ারমূল্য পরিশোধিত হয়ে গেলে তারা দায়মুক্ত। আর্থিক মূল্য দ্বারা প্রতিশ্রুতি দায়সম্পন্ন সদস্যগণ ঐ পরিমাণ অর্থ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত দায়বদ্ধ থাকেন। সাধারণত অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রতিশ্রুত কোম্পানি গঠিত হয় ।
যেসব কোম্পানিতে সদস্যগণের দায় অসীম হয়, তাদের অসীম দায়সম্পন্ন কোম্পানি বলে। এসব কোম্পানিতে সৃষ্ট দায়ের জন্য কোম্পানির সম্পত্তি ছাড়াও শেয়ারহোল্ডারগণের ব্যক্তিগত সম্পত্তি দায়বদ্ধ হয়। বর্তমানে এ ধরনের কোম্পানি নেই বললেই চলে ।
গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করে কোম্পানিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
১. সনদপ্রাপ্ত কোম্পানি (Chartered company): রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজা বা রানীর বিশেষ আদেশ বলে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হয়। বিশেষ করে কোম্পানি আইন চালু হওয়ার পূর্বে এ ধরনের কোম্পানি গঠিত হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, দি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, দি চার্টার্ড ব্যাংক অব অস্ট্রেলিয়া- এ ধরনের কোম্পানির উদাহরণ। বর্তমানে এখন আর এরূপ কোম্পানি সংগঠন দৃষ্টিগোচর হয় না ।
২. বিধিবদ্ধ কোম্পানি (Statutory company) :
যখন দেশের আইন পরিষদ বা পার্লামেন্টে বিশেষ আইনের মাধ্যমে কোনো কোম্পানি গঠিত হয়, তখন তাকে বিধিবদ্ধ কোম্পানি বলে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি এরূপ কোম্পানি ।
৩. নিবন্ধিত কোম্পানি (Registered company) : যেসব কোম্পানি নিবন্ধকের অফিসে তালিকভুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে নিবন্ধিত কোম্পানি বলে। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ কোম্পানিই নিবন্ধিত কোম্পানি ।
সদস্য সংখ্যার উপর ভিত্তি করে কোম্পানিকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা হয়—
১. প্রাইভেট লিঃ কোম্পানি (Private ltd. company): আধুনিক বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে স্বাধীন সত্তা ও সীমিত দায় বিশিষ্ট ছোট ধরনের কোম্পানি সংগঠন হল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। এটি নিজ নামেই সর্বসাধারণ্যে পরিচিত। সাধারণত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে সীমিত দায়ের ভিত্তিতে যে কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয় তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
বস্তুত যে কোম্পানির সদস্য সংখ্যা সর্বনিম্ন দু'জন এবং সর্বোচ্চ পঞ্চাশ জনে সীমাবদ্ধ এবং যার শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য নয়, তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে যে,“প্রাইভেট লিমিটেড” বলতে এমন কোম্পানিকে বুঝাবে যা এর পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা—
ক. কোম্পানির শেয়ার যদি থাকে, হস্তান্তরের অধিকারে বাধানিষেধ আরোপ করে ।
খ. কোম্পানির শেয়ারে বা ডিবেঞ্চারে (যদি থাকে) চাঁদা দানের নিমিত্ত (Subscription) জনসাধারণের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো নিষিদ্ধ করে।
গ. এর সদস্য সংখ্যা কোম্পানির চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ ব্যতীত পঞ্চাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। সদস্য সংখ্যা সীমিত বলে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রায়তনের হয়ে থাকে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানির গঠন থেকে শুরু করে পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে আইনগত ঝামেলা অনেকটা কম । আইন অনুযায়ী এটা স্বাধীন কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে এবং শেয়ারহোল্ডারদেও দায় সীমাবদ্ধ থাকে ।
সুতরাং, প্রচলিত কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধিত হয়ে যে কোম্পানি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা লাভ করলেও পরিমেল নিয়মাবলি অনুযায়ী ৫০ জনের অধিক সদস্য গ্রহণ করতে পারে না, জনসাধারণের উদ্দেশ্যে শেয়ার বিক্রয়ের আহবান জানাতে পারে না এবং শেয়ার মালিকগণ অবাধে শেয়ার হস্তান্তরের সুবিধা ভোগ করে না তাকে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি বলে ।
২. পাবলিক লিঃ কোম্পানি (Public ltd. company): মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ৭ (সাত) জন এবং সর্বোচ্চ যেকোন সংখ্যক (শেয়ার সংখ্যা দ্বারা সীমাবদ্ধ) সদস্য স্বেচ্ছায় সীমিত দায়ের ভিত্তিতে শেয়ার হস্তান্তরের অধিকার নিয়ে কৃত্রিম সত্তাবিশিষ্ট যে প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, তাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলে। এই সংগঠনের মূলধন কতকগুলো খন্ড খন্ড শেয়ারে বিভক্ত এবং শেয়ারগুলো অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ আলাদা। কোম্পানির নির্বাচিত পরিচালক পর্ষদ দ্বারা এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কার্য পরিচালিত হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধিত হবার পর কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে তার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে শুরু করে। বাংলাদেশের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির আইনগত সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২(১-ঞ) ধারায় বলা হয়েছে যে, “পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি বলতে প্রাইভেট কোম্পানি নয় এমন কোম্পানি বোঝায়, যা কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সাল বা কোম্পানি আইন ১৯১৩ বা ১৮৮২ অথবা কোম্পানি আইন ১৮৮৬ অথবা এতদ্বারা বাতিলকৃত অন্য কোন আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত হয়েছে।”
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়। মুনাফা অর্জনের নিমিত্তে বহু সংখ্যক ব্যক্তির ক্রীত শেয়ারের ভিত্তিতে কোম্পানি আইন অনুযায়ী এই কোম্পানি গঠিত ও পরিচালিত হয়।
মালিকানার ভিত্তিতে কোম্পানি দু'রকম হতে পারে। যেমন—
১. সরকারি কোম্পানি (Government company): যেসব কোম্পানি সাধারণত সরকারি মালিকানায় গঠিত হয়, অথবা কোম্পানিতে কমপক্ষে ৫১% শেয়ারের মালিকানা সরকারের থাকে তাকে সরকারি কোম্পানি বলে ।
২. বেসরকারি কোম্পানি (Non-government company): যেসবকোম্পানি বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত হয় সেগুলোকে বেসরকারি কোম্পানি বলে ।
১. হোল্ডিং কোম্পানি (Holding Company): কোন কোম্পানি গঠন বা ক্রয়সূত্রে অন্য কোম্পানি নিয়ন্ত্রণের অধিকাংশ ক্ষমতা পেলে তাকে হোল্ডিং কোম্পানি বা নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি বলে। এরূপ কোম্পানি নিয়ন্ত্রণকৃত কোম্পানির ৫০%-এর অধিক শেয়ারের মালিক এবং অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগ ও অপসারণ ক্ষমতা ভোগ করে।
হোল্ডিং কোম্পানির বৈশিষ্ট্য হলো—
ক. কোন কোম্পানির শেয়ার মূলধনের ৫০% এর বেশি সরবরাহকারী;
খ. সাবসিডিয়ারি কোম্পানির অধিকাংশ পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা এ কোম্পানির উপর ন্যস্ত থাকে;
গ. অধীনস্থ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিষদ নির্বাচনের দায়িত্বও এ কোম্পানি বেশিরভাগই ভোগ করে;
ঘ. পরিচালকদের পদচ্যুতি বা অবসরদানের ক্ষমতাও এর উপর ন্যস্ত থাকে;
ঙ. এ কোম্পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে অধীনস্থ কোম্পানিটি পরিচালিত হয়; ইত্যাদি।
২. সাবসিডিয়ারি কোম্পানি (Subsidiary company): যেসব কোম্পানির ৫০% -এর অধিক শেয়ারের মালিক অন্য কোম্পানি তাকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলে। অর্ধেকের বেশি মূলধন সরবরাহকারী কোম্পানি এরূপ কোম্পানির পুরো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে। নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিকে সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলা হয় ।
৩. বিদেশি কোম্পানি (Foreign company): যে কোম্পানি দেশের বাইরে গঠিত হয়ে, কোনো নির্দিষ্ট দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাকে বিদেশি কোম্পানি বলে ।
৪. বহুজাতিক কোম্পানি (Multinational company):
যে কোম্পানির মালিকানা, ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ন্ত্রণে একাধিক দেশের অধিবাসী অন্তর্ভুক্ত থাকে তাকে বহুজাতিক কোম্পানি বলে। যেমন—ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদি। পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি সংগঠন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। ব্যবহারের বৈচিত্র্য, উদ্দেশ্যের ভিন্নতা কিংবা সময়ের ভিত্তিতে কোম্পানির বিচিত্রতা প্রসারিত হয়েছে।
কোম্পানি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট ব্যবসায় সংগঠন। এই বৃহত্তম ব্যবসায় সংগঠনটি অন্যান্য সংগঠন থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে । বর্তমান ব্যবসায় ও শিক্ষাকর্মের ব্যাপক প্রসারের মূলে রয়েছে যৌথ মূলধনী ব্যবসায়ের অনন্য অবদান । নি েএসমস্ত সুবিধাসমূহ বর্ণনা করা হলো—
১. পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ (Enormous capital): কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের মূল্য হয় কম। কম মূল্যে অধিক সংখ্যক শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করা সহজ হয়। এতে অল্প সঞ্চয়কারীদের নিকট থেকে মূলধন সংগ্রহ করা সুবিধাজনক এবং কোম্পানির মূলধনের পরিমাণও অধিক হয় ।
২. বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান (Establishment of large scale business) : বৃহদায়তন ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনায় কোম্পানি সবচেয়ে উপযোগী সংগঠন। বিপুল পরিমাণ শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপক নিয়োগ করে সহজেই কোম্পানি এ ধরনের ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করতে পারে ।
৩. উত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র (Proper Investment Field): কোম্পানি সংগঠন সারা বিশ্বেই উত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। শেয়ারের মূল্যমান কম হওয়ায় সকল ধরনের মানুষ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর শেয়ার কিনে বিনিয়োগ করতে পারে। লভ্যাংশ ছাড়াও শেয়ারের মূল্যমান বৃদ্ধি, রাইট শেয়ার প্রাপ্তি ইত্যাদি সুবিধা থাকায় তা সবার নিকট আরও অধিক আকর্ষনীয় ।
৪. ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ সৃষ্টি (Creating Facilities of Risk Distribution): একক মালিকানা বা অংশীদারিরভিত্তিতে কখনোই বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ খাতে অর্থ বিনিয়োগ সম্ভব হয় না। অথচ কোম্পানি সংগঠনে ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ থাকায় এতে অর্থ বিনিয়োগের সহজ সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোম্পানি যত বড় হয় বিক্রিত শেয়ারের সংখ্যাও ততই বৃদ্ধি পায়। ঝুঁকিও ততো বেশি বণ্টনের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে ।
৫. দক্ষ পরিচালনা (Efficient management): এ ধরনের কোম্পানি পরিচালনার ভার পরিচালকমণ্ডলীর উপর ন্যস্ত থাকে। পরিচালকমণ্ডলী গঠিত হয় দক্ষ পরিচালকগণ দ্বারা। অবশ্য পরিচালকমণ্ডলী পরিবর্তনযোগ্য। অর্থাৎ প্রয়োজনে পুরাতন পরিচালকমণ্ডলীকে পরিবর্তন করে দক্ষ পরিচালক নিযুক্ত করা যায় ।
৬. গণতান্ত্রিক পরিচালনা (Democratic management): এ ধরনের কোম্পানি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোম্পানির সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে এর ব্যবস্থাপনা গণতান্ত্রিক ।
৭. জনগণের আস্থা (Public confidence): কোম্পানির গঠন, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা নির্ধারণ হয় বলে এতে আইনের বাধ্যবাধকতাও বেশি থাকে। ফলে ব্যবসায়ের উপর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং বিনিয়োগকারীগণ নির্ভয়ে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে।
৮. আন্তর্জাতিক সুনাম (International goodwill) : বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি শুধু যে দেশের মধ্যে জনসাধারণের আস্থা অর্জন করে তা নয়, বরং দেশের বাহিরেও এদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের ব্যবসায়িক কার্যকলাপ ছড়িয়ে পড়ে। এক কথায় বলা যায় বৈদেশিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যৌথমূলধনী কোম্পানিই হলো একমাত্র উপযুক্ত ব্যবসায় সংগঠন।
৯. গবেষণা (Research): নতুন উৎপাদনের কৌশল আবিস্কার, উৎপাদন-ব্যয় হ্রাস ইত্যাদির উদ্দেশ্যে কোম্পানি গবেষণা কার্যে অর্থ ব্যয় করতে পারে যা একমালিকানা বা অংশীদারি ব্যবসায় সম্ভব নয়।
১০. করের সুবিধা (Tax relief): অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠনের করের হার অপেক্ষা কোম্পানির করের হার কম। অপরদিকে নতুন কোম্পানিগুলো কিছুদিন পর্যন্ত কর প্রদান থেকে রেহাই পায়।
পরিশেষে বলা যায়, উপরিউক্ত সুবিধাদি ছাড়াও এ ব্যবসায় হতে সমাজ, সরকার তথা দেশের সকল জনগণই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। এ কারণে বর্তমানে এরূপ ব্যবসায় গঠনে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় ।
১. সীমিত দায়ঃ যৌথ মূলধনী কোম্পানির শেয়ারের আঙ্কিক মূল্য (Face value) অথবা প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে । ফলে জনগণ বিনাদ্বিধায় ও সংগঠনে বিনিয়োগ করে ।
২. অধিক পুঁজি: এ সংস্থা জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রি করে পর্যাপ্ত পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি প্রয়োজনে ঋণপত্র বিক্রির মাধ্যমেও মূলধন সংগ্রহ করা যায়, যা অন্যান্য সংগঠনগুলো পারে না।
৩. চিরন্তন অস্তিত্বঃ আইনের সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা একে চিরন্তন অস্তিত্ব প্রদান করেছে। ফলে এর স্থায়িত্ব অধিক। এমনকি ঘটনাক্রমে কোম্পানির সকল সদদ্যের মৃত্যু হলেও সংস্থা বিলুপ্ত হয় না। অর্থাৎ এটা নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে এর বিশেষ আইনগত সার্বজনীন সত্তা আছে। যা ব্যবসায়ের উন্নতির সহায়ক ।
৪. গণতান্ত্রিকতা: এটা আইনের আওতায় সার্বিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
৫. জনসাধারণের আস্থা: নির্দিষ্ট আইনের দ্বারা এ সংস্থা গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় বলে এটা জনগণের অধিক আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ফলে বিনিয়োগকারীগণ নিশ্চিন্তে এ সংগঠনে বিনিয়োগ করে এবং কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার কারণে কোম্পানি অধিক ঋণের সুবিধা ভোগ করে।
৬. অধিক উৎপাদনঃ বৃহদায়তনের কারণে এ সংগঠন ব্যাপক উৎপাদন করতে পারে এবং জনগণ কমমূল্যে পণ্যক্রয়ের সুযোগ পায় ।
৭. কর্মসংস্থানের সুযোগঃ অন্য যে কোনো ব্যবসায়ের তুলনায় বৃহদায়তনের কোম্পানিতে জনগণের কর্মের সুযোগ-সুবিধা বেশি। ফলে জনগণের অধিক কর্মসংস্থান করে যৌথ মূলধনী কোম্পানি দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোম্পানি সংগঠন হলো আইন-সৃষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যা কোম্পানি আইনের নির্ধারিত পন্থায় গঠিত ও পরিচালিত হয়। পাবলিক ও প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি উভয় “কোম্পানি আইন ১৯৯৪” অনুসারে গঠিত ও পরিচালিত হয়। কোম্পানি গঠনে বিভিন্ন পর্যায়ে কতকগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ বা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে ।
নিম্নে এ আইন অনুযায়ী কোম্পানি আইনের পদক্ষেপ/পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
একাধিক ব্যক্তি কোম্পানি গঠনের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন । কোম্পানি গঠনের জন্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৭ জন এবং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ জন উদ্যোক্তার প্রয়োজন হয়। ব্যবসায়ের সম্ভাবনা, সাফল্য ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে তারা কোম্পানি গঠনের প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ।
এ ব্যক্তিবর্গ বা প্রবর্তকগণ এ পর্যায়ে নিম্নোক্ত কাজ সম্পাদন করেন:
ক. প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ
খ. নামের ছাড়পত্র সংগ্রহ
Documents Preparation Stage পরিকল্পনা তৈরির পর উদ্যোক্তাগণ কোম্পানির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিম্নোক্ত দুটি দলিল প্ৰণয়ন করেন—
ক. স্মারকলিপি/সংঘস্মারক বা পরিমেলবদ্ধ (Memorandum of Association): এটি কোম্পানির মূল দলিল বা সনদ। এ দলিলে কোম্পানির নাম, কোম্পানির নিবন্ধিত অফিসের ঠিকানা, কোম্পানির মূল লক্ষ্যসমূহ, শেয়ার, মূলধনের পরিমাণ, শেয়ারের আংকিক মূল্যসহ মূলধনের বিভক্তি এবং এটি প্রাইভেট লিমিটেড না-কি পাবলিক লিমিটেড তা উল্লেখ করা অবশ্যক ।
খ. সংঘবিধি বা পরিমেল নিয়মাবলি (Articles of association): এ দলিলে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়ম-পদ্ধতি লেখা হয়। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি আইনে বর্ণিত তফসিল-১ কে সংঘবিধি হিসেবে গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে তাকে আর এ দলিল তৈরি করতে হয় না ।
এ পর্যায়ে প্রবর্তকগণ কোম্পানি নিবন্ধকের অফিস হতে প্রয়োজনীয় ফরম সংগ্রহ করন এবং তা পূরণপূর্বক দলিলপত্র সন্নিবেশিত করে নিবন্ধকের নিকট জমা দেন। অবশ্য জমাদানের সময় মূলধন অনুপাতে প্রয়োজনীয় স্ট্যাম্প ও ফি এর সাথে দাখিল করতে হয়।
আবেদনপত্রের সাথে নিম্নোক্ত দলিল ও কাগজপত্র জমা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে—
ক. কোম্পানির স্মারকলিপির তিন কপি ;
খ. সংঘবিধির তিন কপি; অবশ্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তফসিল-১ কে সংঘবিধি হিসেবে গ্রহণ করলে এ মর্মে ঘোষণাপত্রের কপি;
গ. উদ্যোক্তা পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা;
ঘ. উদ্যোক্তা পরিচালকেরা নিজ স্বাক্ষরযুক্ত দায়িত্বপালনের সম্মতিপত্র; ঙ. উদ্যোক্তা পরিচালকগণ যোগ্যতাসূচক শেয়ার ক্রয়ে সম্মত আছেন এ মর্মে একটি চুক্তিপত্র ও
চ. হাইকোর্টের উকিল অথবা সংঘবিধিতে উল্লেখ কোনো পরিচালক বা সচিব পদের অধিকারী ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত যথার্থতার ঘোষণাপত্র ।
উপরোক্ত সবকিছু ঠিকভাবে পেয়ে নিবন্ধক নিবন্ধন বইতে কোম্পানির নাম তালিকাভুক্ত করেন এবং প্রবর্তকদের নিবন্ধনপত্র (Certificate of Incorporation) এবং চাইলে প্রত্যায়িত স্বারকলিপি ও সংঘবিধির কপি প্রদান করেন। এর পরই প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি কাজ শুরু করতে পারে কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কাজ শুরু করার জন্য নিবন্ধকের নিকট হতে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় ।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র পাওয়ার জন্য ন্যূনতম চাঁদা (Minimum Subscription) সংগ্রহের ঘোষণাপত্র এবং জনসাধারণের নিকট শেয়ার বিক্রয়ের ঘোষণাপত্রসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রসহ আবেদন করতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে এবং সন্তুষ্ট হলে নিবন্ধক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র প্রদান করেন। এ পত্র পাওয়ার পরেই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ব্যবসায় শুরু করতে পারে।
স্মারকলিপি হলো কোম্পানির মূল দলিল, সনদ বা সংবিধান। এতে কোম্পানির মূল বিষয়াবলি; যেমন-নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্য, মূলধন, দায় ও সম্মতির বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে। এটা কোম্পানির কার্যক্ষেত্র ও ক্ষমতার সীমা নির্দেশ করে । এতে অন্তর্ভূক্ত নেই এমন কোনো কাজ কোম্পানী সম্পাদন করতে পারে না।
কোম্পানি আইনের ৬ ধারায় শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানির ৭ ধারায় প্রতিশ্রুতি দ্বারা সীমাবদ্ধ কোম্পানির এবং ৮ ধারায় অসীম দায় কোম্পানির স্মারকলিপির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে।
নিম্নে স্মারকলিপির ধারাসমূহ উল্লেখ করা হলো-
১. নাম ধারা (Name Clause) : কোম্পানির নাম এবং নামের শেষে পাবলিক কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘লিমিটেড’ এবং প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট লিমিটেড' -এ শব্দগুলো যোগ করতে হবে। কোম্পানির যেকোনো নাম রাখা যেতে পারে ।
তবে নাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অত্র আইনের ১১ ধারায় বর্ণিত নিম্নেক্ত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়—
i) একটি বিদ্যমান কোম্পানি ইতোপূর্বে যে নামে নিবন্ধিত হয়ে উক্ত নামেই বহাল আছে অথবা যে নামের সাথে প্রস্তাবিত নামের এমন সাদৃশ্য থাকে যে, উক্ত সাদৃশ্যের ফলে প্রতারণা করা সম্ভব।
ii) সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের দ্বারা অনভিপ্রেত বলে ঘোষণা করেছে; এমন কোনো নাম সরকারের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে গ্রহণ করা যাবে না ।
iii) জাতিসংঘ বা জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত এর কোনো সহায়ক সংস্থা অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম বা ঐসব নামের শব্দ সংক্ষেপ সংবলিত কোনো নাম, জাতিসংঘ বা এর সহায়ক সংস্থার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্ষেত্রে এর ডাইরেক্টর জেনারেলের লিখিত পূর্ব অনুমতি ব্যতীত
ব্যবহার করা যাবে না।
২. অবস্থান ও ঠিকানা ধারা (Situation and Address Clause): কোম্পানির নিবন্ধিত কার্যালয় যে অঞ্চলে অবস্থিত থাকবে সে স্থানের নাম। এর সাথে কোম্পানি কোন কোন এলাকায় এর কার্যাবলি বিস্তৃত করবে তাও বর্ণিত থাকবে ।
৩. উদ্দেশ্য ধারা (Objective Clause): কোম্পানি কি ধরনের ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকবে তা এ ধারায় বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে। এ উদ্দেশ্যের বাইরে কোনো ব্যবসায় করা যায় না। এ ধারা একদিকে কোম্পানির ক্ষমতাকে সংজ্ঞায়িত করে এবং অন্যদিকে কোম্পানি প্রদত্ত ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে। উক্ত ধারায় কোম্পানির সম্ভাব্য ক্ষেত্রসমূহের বর্ণনা থাকে এবং ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে কী কী ব্যবসায় করতে পারবে তাও বিশদভাবে বর্ণিত থাকে ।
৪. দায় ধারা (Liability Clause): কোম্পানির সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংকিক মূল্য (Face value) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। শেয়ারের অপরিশোধিত মূল্যের জন্য কেবল শেয়ারহোল্ডারদেরকে দায়ী করা যাবে এবং শেয়ারের মূল্য সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করলে তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্ত হবেন।
৫. মূলধন ধারা (Capital Clause): প্রস্তাবিত মোট মূলধনের পরিমাণ এবং মূলধন কতকগুলো এবং কী প্রকারের শেয়ারে বিভক্ত থাকবে তা এ ধারায় উল্লেখ থাকে। কোম্পানির এ মূলধনকে নিবন্ধিত বা অনুমোদিত মূলধন বলা হয়। এর অতিরিক্ত মূলধন কোম্পানি সংগ্রহ করতে পারে না ।
৬. সম্মতি ধারা (Consent Clause): স্মারকলিপির শেষ অংশে প্রত্যেক সদস্য তাঁর নামের বিপরীতে কতগুলো শেয়ার ক্রয় করবেন তার সম্মতি ধারা সম্পর্কে নিরূপ বিধান বর্ণিত হয়েছে—
i. সংঘ-স্মারকে স্বাক্ষর প্রদানকারী প্রত্যেক সদস্যকে কমপক্ষে একটি শেয়ার ক্রয় করতে হবে । [ ধারা ৬ (খ)]
ii. প্রত্যেক স্বাক্ষরকারী সদস্যকে তার নামের বিপরীতে ক্রয়কৃত শেয়ারের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে । [ধারা ৬ (গ)]
iii. প্রত্যেক স্বাক্ষরকারী সদস্য অন্ততঃপক্ষে দু'জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর প্রদান করবেন এবং উক্ত স্বাক্ষর সাক্ষী কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে। [ধারা ৯(গ)
পরিশেষে বলা যায়, উপযুক্ত ধারাসমূহ বর্ণিত সকল ধরনের কোম্পানিকে সর্বদা অনুসরণ করতে হয়। এর কোনো একটি শর্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনুমোদন ও বিশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষেত্র বিশেষে আদালত ও সরকারের অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়।
একটা দেশের জন্য তার সংবিধানের আইনগত মর্যাদা যেমন একটা কোম্পানির জন্য তার সংঘস্মারকের মর্যাদাও ঠিক অনুরূপ বললেও অত্যুক্তি হয় না। সংঘস্মারকের গুরুত্ব বা আইনগত তাৎপর্যকে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. ক্ষমতার নির্দেশ (Indication of power): স্মারকলিপি কোম্পানির কার্যক্ষমতার সীমা নির্দেশ করে। এরূপ দলিলের উদ্দেশ্য ধারায় বর্ণিত কাজ বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক কাজ কোম্পানি করতে পারে। এর বাইরে কোনো কাজ করা হলে তা ক্ষমতা বহির্ভুত কাজ বিবেচিত হয়।
২. সম্পর্ক নির্দেশ (Indication of relationship): সংঘস্মারকের শর্তগুলি দ্বারা কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে একটি চুক্তি বা আইনগত বন্ধনের সৃষ্টি হয় । অর্থাৎ কোম্পানি ও শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যকার সম্পর্ক এর দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে । কোম্পানিতে তাদের অধিকার এবং দায়ও এর মাধ্যমে নিরূপিত হয় ।
৩. যথানিয়মে পরিবর্তন আবশ্যক (Necessary to change at law): আইনে উল্লেখিত কারণ ব্যতিরেকে এবং আইন মাফিক আনুষ্ঠানিকতা পালন না করে শেয়ারহোল্ডারদের সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের দ্বারা সংঘস্মারক পরিবর্তন করা যায় না । অর্থাৎ এরূপ দলিল যথানিয়মে পরিবর্তন আবশ্যক ।
৪. ক্ষমতা বহির্ভূত কাজের দায় (Liability for ultra vires activites): কোম্পানির পরিচালকরা যদি স্মারকলিপির ক্ষমতা বহির্ভুত কোনো কার্য করে তবে তার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে তারা কোম্পানির বা তৃতীয় পক্ষের নিকট দায়ী থাকে।
৫. সংঘস্মারকের অগ্রগণ্যতা (Primacy of memorandum of asociation): সংঘস্মারক ও সংঘবিধির মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে শেয়ারহোল্ডাররা সংঘবিধি সংশোধন করে উক্ত কার্য অনুমোদন করতে পারে। কিন্তু সংঘস্মারক বহাল থাকে। অর্থাৎ এরূপ দলিল সবসময়ই মুখ্য বিবেচিত হয়।
৬. প্রকাশ্য দলিল (Exressed document): সংঘস্মারক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ্য দলিল। সুতরাং কোম্পানির সাথে লেনদেনে সকল পক্ষ তা অবগত আছে বলে ধরা হয়। এরূপ দলিল সম্পর্কে জানা ছিল না এই অজুহাত কখনই আদালতে গ্রাহ্য হয় না ।
উপসংহারে বলা যায় যে, স্মারকলিপি কোম্পানির মুখ্য দলিল, সনদ বা সংবিধান। প্রত্যেক কোম্পানির জন্য এ ধরণের দলিল তৈরি অপরিহার্য। প্রথম পরিচালক ও উদ্যোক্তাদের নাম এবং স্বাক্ষর এতে থাকায় তা কোম্পানির ঐতিহ্যের প্রকাশ করে ।
কোম্পানির স্মারকলিপি পরিবর্তন বেশ আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ ও জটিল কাজ। স্মারকলিপির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তু পরিবর্তনের ভিন্ন নিয়ম কোম্পানি আইনে বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে পদ্ধতিসমূহ আলোচনা করা হলো—
১. নাম ধারার পরিবর্তন (Change of name clause): এই ধারার পরিবর্তনের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস করতে হয় এবং এ বিষয়ে সরকারের অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়। অতঃপর বিশেষ প্রস্তাব পাসের ও সরকারের অনুমতির অনুলিপি কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়।
আইনগত সমস্যা দেখা না দিলে নিবন্ধক, বইতে পুরাতন নাম বাদ দিয়ে নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করেন এবং এ মর্মে সার্টিফিকেট প্রদান করেন । অতঃপর নাম পরিবর্তন কাজ সমাপ্ত হয় ।
২. উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তন (Change of objects clause): এই ধারার পরিবর্তনে শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় এই মর্মে বিশেষ প্রস্তাব পাস করে আদালতের অনুমোদন লাভ করতে হয়। আদালতের অনুমোদন লাভের পর নব্বই দিনের মধ্যে সংশোধিত স্মারকলিপির মুদ্রিত কপি ও অনুমোদন লাভের প্রতিলিপি নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়। নিবন্ধক সংশোধিত স্মারকলিপি অনুমোদন করলে উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়।
অবশ্য নিম্নলিখিত যে কোনো একটি কারণেই শুধুমাত্র এই ধারায় পরিবর্তন করা যায়—
ক. অধিকতর ব্যয় সংকোচ ও ব্যবসায় পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য;
খ. নতুন অথবা উন্নততর উপায়ে কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য;
গ. স্থানীয় কার্যক্ষেত্র পরিবর্তন করার জন্য:
ঘ. এমন কোনো নতুন ব্যবসায় আরম্ভ করার জন্য যা কোম্পানির বর্তমান ব্যবসায়ের সাথে লাভজনকভাবে যুক্ত করা যায়;
ঙ. স্মারকলিপিতে উল্লেখিত কোনো উদ্দেশ্য সংকোচন বা পরিত্যাগ করার জন্য;
চ. কোম্পানির যাবতীয় ব্যবসায় অথবা ব্যবসায়ের অংশবিশেষ অথবা একাধিক ব্যবসায়ের কোনো একটি বিক্রয় কিংবা হস্তান্তর করার জন্য;
ছ. অন্য কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তিবর্গের সাথে একত্রীভূত হওয়ার জন্য ।
৩. অবস্থান ও ঠিকানা ধারার পরিবর্তন (Change of situation and address clause) : এ ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য ধারা পরিবর্তনের অনুরূপ সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস এবং আদালতের অনুমোদন লাভ করতে হয় এবং তা নিবন্ধককে জানাতে হয়। উদ্দেশ্য ধারার পরিবর্তনের নায় যেকোনো একটি কারণ এরূপ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়ে থাকে। তবে একই শহরের মধ্যে বা স্থানীয় এলাকার মধ্যে ঠিকানা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঠিকানা স্থানান্তরের ২৮ দিনের মধ্যে এই সম্পর্কে কোম্পানি নিবন্ধককে বিজ্ঞপ্তি দিলেই চলে ।
৪. মূলধন ধারার পরিবর্তন (Change of capital clause): কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলীতে মূলধন পরিবর্তন সম্পর্কে বিধান থাকলে কোম্পানির মূলধন হ্রাস বা বৃদ্ধি করা যায়। মূলধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাধারণ সভায় সাধারণ প্রস্তাব পাস করলেই চলে। কিন্তু মূলধনের পরিমাণ হ্রাস করতে হলে শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভায় বিশেষ প্রস্তাব পাস করে আদালতের অনুমতি নিতে হয়। অতঃপর কোম্পানির স্মারকলিপিতে নতুন মূলধনের পরিমাণ উল্লেখ করে প্রস্তাব গ্রহণের পর ১৫ দিনের মধ্যে মূলধন পরিবর্তনের ঘোষণা নিবন্ধকের নিকট দাখিল করতে হয়।
পরিমেল নিয়মাবলি দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে শেয়ার মূল্য দ্বারা দায় সীমাবদ্ধ কোনো কোম্পানি নিম্নলিখিত যেকোনো উপায়ে মূলধন পরিবর্তন বা হ্রাস বৃদ্ধি করতে পারে—
ক. নতুন শেয়ার বিলি;
খ. বর্তমান শেয়ারের মূল্যমান বৃদ্ধি;
গ. শেয়ারগুলোকে পুনরায় বিভক্ত করে অল্প মূল্যের শেয়ারে পরিবর্তনকরণ;
ঘ. বণ্টন করা হয়নি বা বাতিল করা হয়েছে এমন শেয়ার হিসাব হতে বাদ দিয়ে শেয়ার মূলধন হ্রাস ।
এটি কোম্পানির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এতে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধি-বিধান অর্থাৎ কোম্পানি কীভাবে পরিচালিত হবে তা উল্লেখ থাকে। অবশ্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে কোম্পানি আইনে বর্ণিত তফসিল-১ কে কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলি হিসেবে গ্রহণ করা যায়। সেক্ষেত্রে দলিল তৈরির প্রয়োজন হয় না । প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এটি প্রস্তুত বাধ্যতামূলক।
পরিমেল নিয়মাবলি হলো কোম্পানির দ্বিতীয় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল, যার মধ্যে কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদি লিপিবদ্ধ থাকে। স্মারকলিপির অধীনে এ দলিল কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-কলাপের দিক-দর্শন হিসেবে ভূমিকা রাখে, কোম্পানির পরিমেল নিয়মাবলিতে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত সেগুলো নিরূপ—
১. প্রতিষ্ঠানের নামঃ কোম্পানির নাম এবং নামের শেষে লিমিটেড বা সীমিত সংক্ষেপে লিঃ শব্দটি বসাতে হবে।
২. কোম্পানির পরিচালক সংক্রান্ত নিয়মাবলি—
i.পরিচালক সংখ্যা;
ii. পরিচালক, ব্যবস্থাপকের নাম, ঠিকানা, পেশা ও অন্যান্য বিবরণী;
iii. প্রথম পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা
iv. ব্যবস্থাপক ও পরিচালকদের দায়-দায়িত্ব, অধিকার ও কর্তব্য;
v. পরিচালকদের যোগ্যতাসূচক শেয়ার ও মূল্য;
vi. পরিচালকদের পারিশ্রমিক;
vii. পরিচালকদের অবসর গ্রহণ, দায়িত্ব অব্যাহতি ইত্যাদি সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
৩. অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়োগ পদ্ধতি—
i. ম্যানেজিং এজেন্ট ;
ii. সলিসিটার;
iii. দালাল;
iv. অবলেখকের নাম;
v. পেশা।
৪. মূলধন সংক্রান্ত নিয়মাবলি
i. অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ;
ii. মূলধনের শ্রেণীবিভাগ ও পরিমাণ;
iii. ন্যূনতম মূলধনের পরিমাণ;
iv. মূলধনের পরিবর্তন বা হ্রাস-বৃদ্ধির নিয়ম;
৫. শেয়ার সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. মোট শেয়ারের সংখ্যা ও শ্রেণীবিভাগ;
ii. প্রতি শেয়ারের মূল্য;
iii. শেয়ার ক্রয়ের জন্য জনসাধারণকে আহবানের নিয়ম;
iv. শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নিয়মাবলি;
v. শেয়ার বিক্রয়ের কমিশন ও দালালি
vi. শেয়ার মূল্য পরিশোধের নিয়মাবলি;
vii. শেয়ার বিক্রয় পদ্ধতি;
viii. শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ পদ্ধতি ও শর্তাবলি:
ix. শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত নিয়মাবলি ;
x. শেয়ারহোল্ডারদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার;
xi. বিভিন্ন শ্রেণীর শেয়ারমালিকদের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা ও অধিকার ।
৬. কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. কোম্পানির ঋণ গ্রহণ সংক্রান্ত নিয়মাবলি;
ii. কোম্পানির ঋণ গ্রহণ ক্ষমতার বিবরণ;
iii. ঋণ গ্রহণ পদ্ধতি ।
৭. কোম্পানির সভা সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. কোম্পানির সভা আহ্বান ও সভা পরিচালনা পদ্ধতি;
ii. সভার ভোট গ্রহণ পদ্ধতি;
iii. বিভিন্ন সভার কোরাম সংক্রান্ত নিয়ম;
iv. সাধারণ সভা ও বিশেষ সভা অনুষ্ঠানের নিয়মাবলি ।
৮. কোম্পানির লভ্যাংশ সংক্রান্ত নিয়মাবলি:
i. লভ্যাংশ ঘোষণার পদ্ধতি;
ii. লভ্যাংশকে মূলধনে রূপান্তরিত করার নিয়মাবলি ।
৯. কোম্পানির ব্যাংকের হিসাব সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
১০. কোম্পানির ঋণ গ্রহণের পদ্ধতি ও নিয়মাবলি ।
১১. কোম্পানির সিলমোহর সংক্রান্ত নিয়মাবলি ।
i. এর সংরক্ষণ ও
ii. ব্যবহার-বিধি ।
“Prospectus is an advertisement of a company " সাধারণত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি জনগণের কাছে শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ের জন্য কোম্পানির পরিপূর্ণ তথ্য সম্বলিত যে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, সেটি বিবরণ পত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা চালানো হয়। একে কোম্পানির দর্পণের (Mirror) সাথে তুলনা করা হয় ।
সাধারণত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধনের ছাড়পত্র সংগ্রহের পর মূলধন সংগ্রহের নিমিত্তে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা জানিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে যে পত্র রচনা করা হয় তাকে বিবরণপত্র বলে । মূলত কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র পাবার নিমিত্তে নিবন্ধনের ছাড়পত্র অর্জনের সাথে সাথে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগণ যে পত্রের মাধ্যমে জনগণকে শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ক্রয়ের আহবান জানায় তাকে বিবরণপত্র বা প্রসপেকটাস বলে ।
প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি যখন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় বা নতুন কোম্পানি বাজারে শেয়ার ছেড়ে মূলধন সংগ্রহের সময় জনসাধারণকে অবহিত করা বা উৎসাহিত করার জন্যই বিবরণী প্রচার করে থাকে। বিবরণ পত্রে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যা জনগণকে এ কোম্পানি সম্পর্কে পূর্ণ
বিবরণ দিতে সক্ষম ।
একটি বিবরণ পত্রে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত তা নিরূপ—
১. কোম্পানির নাম, ঠিকানা, উদ্দেশ্যাবলি ।
২. অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ও বিবরণ।
৩. শেয়ার ক্রয়ের আবেদন, আবণ্টন ও তলবে প্রদেয় অর্থের পরিমাণ এবং আবেদনপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ।
8. ন্যূনতম মূলধন সংগ্রহের পরিমাণ।
৫. প্রাথমিক খরচের পরিমাণ।
৬. পরিচালকদের নাম, ঠিকানা ও পেশা ।
৭. পরিচালকদের যোগ্যতাসূচক শেয়ার ক্রয়ের সংখ্যা ও মূল্য।
৮. পরিচালকদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ ।
৯. পরিচালক পর্ষদের সদস্যদের স্বাক্ষর।
১০. সম্পত্তির বিস্তারিত বিবরণ।
১১. পরিচালকদের দেয় অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা ।
১২. লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতি ।
১৩. কোম্পানির নিরীক্ষকের নাম ও ঠিকানা ।
১৪. কোম্পানি আইন উপদেষ্টার নাম ও ঠিকানা।
১৫. কোম্পানির ব্যাংকারের নাম ও ঠিকানা।
১৬. কোম্পানির হিসাব নিরীক্ষণের নিয়মাবলি ।
১৭. তৃতীয় পক্ষের সাথে সম্পাদিত চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ।
১৮. স্মারকলিপির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ।
১৯. পরিমেল নিয়মাবলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।
২০. পরিচালকগণের স্বার্থ ।
২১. শেয়ারের শ্রেণীবিভাগ ও প্রত্যেক শেয়ারের সংখ্যা।
২২. প্রতি শেয়ারের বিক্রয়মূল্য এবং পরিশোধ পদ্ধতি ।
২৩. কোম্পানিতে শেয়ার মালিকদের স্বার্থ ।
২৪. শেয়ার বণ্টনের দায় কেউ গ্রহণ করলে তার নাম ও ঠিকানা।
২৫. কোম্পানির পূর্ব ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
২৬. ম্যানেজিং এজেন্ট বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নাম, ঠিকানা, পারিশ্রমিক এবং নিয়োগ পদ্ধতি ।
২৭. চলতি মূলধনের পরিমাণ ।
২৮. শেয়ার আবেদনের সময় এবং বরাদ্ধের জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে তার পরিমাণ ।
২৯. কোম্পানির নিকট সম্পত্তি বিক্রেতাদের নাম ঠিকানা ও পরিচয় ।
৩০. কোন উদ্যোক্তাদের নাম, ঠিকানা এবং কোনো অর্থ বা সুবিধা প্রদান করা হলে তার বিবরণ ।
৩১. কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিসমূহের তারিখ, পক্ষসমূহ।
৩২. কোম্পানির ব্যবসায় চালু থাকলে বিগত কয়েক বছরের উদ্বৃত্ত পত্র ও লাভ -ক্ষতির হিসাব বিবরণী।
৩৩. বিবরণপত্র প্রচারের তারিখ ও পরিচালকদের প্রত্যেকের স্বাক্ষর ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে পারি যে, সব ধরনের কোম্পানির বিবরণপত্রেই উল্লেখিত সবগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত নাও থাকতে পারে । প্রবর্তক বা পরিচালকরা বিচার-বিবেচনা করে কোম্পানির বিবরণপত্রের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে থাকে। তবে কোনো অবস্থাতেই বিবরণ পত্রে মিথ্যা তথ্য-পরিবেশন করা যাবে না ।
শেয়ার দ্বারা সীমাবদ্ধ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির বিবরণপত্র নিবন্ধকের নিকট পেশ করা এবং সেগুলো জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রচার করা বাধ্যতামূলক। তবে কোম্পানিকে সর্বক্ষেত্রেই তা প্রচার করতে হবে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অনেক সময় দেখা যায় কোম্পানির প্রবর্তকগণ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আর বিবরণপত্র প্রচার করার প্রয়োজন হয় না । তখন ১৯৯৪ সালের আইনে বর্ণিত তফসিল-৪ অনুযায়ী একটি বিকল্প বিবরণপত্র প্রস্তুত করতে হয় এবং তার এক কপি নিবন্ধকের নিকট প্রেরণ করতে হয় । তা না হলে কোম্পানি শেয়ার বা ঋণপত্র বিলি করতে পারে না। অর্থাৎ, একটি কোম্পানি গঠনের প্রয়োজনীয় মূলধন যখন প্রবর্তকগণ তাদের নিজস্ব আত্মীয়স্বজন অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করতে সমর্থ হন তখন বিবরণপত্র প্রচারের পরিবর্তে নিবন্ধকের নিকট যে বিবৃতি প্রদান করা হয় তাকে বিবরণপত্রের বিকল্প বিবৃতি বলে অভিহিত করা হয় ।
কোম্পানি আইনের বিভিন্ন বিধান বা আনুষ্ঠানিকতা পালন শেষে কোনো কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগন কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট হতে নিবন্ধনের প্রমান হিসাবে যে দলিল সংগ্রহ করে তাকেই নিবন্ধনপত্র বলে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এরূপ দলিল পাওয়ার পরই কাজ শুরু করতে পারে; কিন্তু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এরূপ দলিল প্রাপ্তির পর অস্তিত্বের সৃষ্টি হলেও কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র সংগ্রহের পূর্বে তারা কাজ শুরু করতে পারে না।
নিম্নে কোম্পানির নিবন্ধনপত্রের একটি নমুনা দেয়া হলো—
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে নিবন্ধনপত্র পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় দলিল পত্রসহ কোম্পানি নিবন্ধকের নিকট কার্যারম্ভের অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হয়। আবেদনে ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ৫০ ধারার নিয়ম সঠিকভাবে পালিত হলে নিবন্ধক কোম্পানিকে কার্যারম্ভের অনুমতি দিয়ে একখানা পত্র প্রদান করেন, যা কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র নামে পরিচিত।
কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রে যেসব বিষয় উল্লেখ থাকে, তাহলো—
i. নিবন্ধন অফিসের নাম ও ঠিকানা ;
ii. কার্যারম্ভের অনুমতিপত্র ইস্যুর তারিখ ;
iii. কার্যারম্ভের তারিখ ;
iv. পত্র নম্বর ;
v. অফিস সীল ;
vi. নিবন্ধকের নাম ও পদবিসহ সিল ও স্বাক্ষর ;
vii. কোনো শর্তযুক্ত থাকলে তার বিবরণ ইত্যাদি ।
নিম্নে কার্যারম্ভের অনুমতিপত্রের একটি চিত্র দেয়া হলো—
আধুনিক ব্যবসায়ের জগতে মূলধনকে জীবনীশক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থ ছাড়া যেকোনো ব্যবসায়ই অচল যেমন রক্ত ছাড়া মানুষের শরীর। আমাদের চারপাশে যেসব ব্যবসায় সংগঠন আমরা দেখি সেগুলোর মধ্যে ব্যবসায়ের উপাদান সবগুলো একসাথে নাও থাকতে পারে। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে একটি মূল উপাদান অবশ্যই আছে আর তা হলো অর্থ। ব্যবসায়ের প্রাথমিক ব্যয় নির্বাহ, উৎপাদন কার্য অব্যাহত রাখা, পণ্য বিতরণ ও শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ প্রভৃতি সকল কাজে অর্থের প্রয়োজন। এজন্যই ব্যবসায়ের সফলতা অনেকাংশেই অর্থসংস্থানের উপর নির্ভর করে। অর্থ সংস্থান মূলত প্রতিষ্ঠানের অর্থের প্রয়োজন নির্ধারণ, উৎস অনুসন্ধান, ব্যবহার নিরূপণ, ভবিষ্যতের জন্য অর্থ সংরক্ষণ, সামগ্রিক অর্থ সংরক্ষণ ও সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত।
কোম্পানি ব্যবসায়ে অর্থসংস্থানের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো-
অর্থবাজার হতে শিল্প তথা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বল্পমেয়াদি মূলধন বা পুঁজি সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত এক বছরের জন্য স্বল্প মেয়াদি অর্থের সংস্থান করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশীয় ঋণদাতা গোষ্ঠী, ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধিবৃন্দ, বিল বাজার, সমবায় ব্যাংক, ভূমিবন্ধকি ব্যাংক প্রভৃতি নিয়ে স্বল্প মেয়াদি ঋণের উৎস অর্থবাজার গঠিত হয়।
১. মালিকের তহবিল (Owner's Fund):
ব্যবসায়ে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের ক্ষেত্রে মালিকের তহবিলকে প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মালিক প্রথমত তার নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেন। মালিকের তহবিল হতে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে ব্যবসায়ের চলতি মূলধনের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে এ উৎস হতে সংগৃহীত অর্থ অপর্যাপ্ত হলে অন্যান্য উৎস হতে অর্থায়নের চেষ্টা করা হয় ।
২. ব্যবসায় ঋণ (Trade Credit) : ব্যবসায় ঋণ এমন এক ধরনের ঋণ যা ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের ফলে সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ঋণের আওতায় পণ্য সামগ্রীর বিক্রেতা পণ্য বিক্রয়ের একটি নির্দিষ্ট সময় পর ক্রেতার কাছ হতে মূল্য গ্রহণ করে থাকে। ফলে ক্রেতার নিকট এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূল্য পরিশোধ না করার সুবিধা ঋণ হিসেবে বিবেচিত, যাকে ব্যবসায় ঋণ বলা হয়। অর্থাৎ, ব্যবসায় ঋণ এমন এক ধরনের ঋণকে বুঝায় যা একজন ব্যবসায়ের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ফলে পণ্য সরবরাহকারীর কাছ থেকে পেয়ে থাকে। বর্তমানে উন্নয়নশীল ব্যবসায় জগতে এরূপ ঋণের ব্যবহার ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানকে খুবই সহজ করেছে ।
৩. বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial Bank): বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী বলা হয়। ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ হলো বিভিন্ন ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় স্বল্প মেয়াদি ঋণ দেয়া। সুতরাং যে কোনো ব্যবসায়ীর অর্থের প্রয়োজন হলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ হতে স্বল্পমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ধার, নগদ ঋণ ও জমাতিরিক্ত ঋণ হিসেবে অর্থ দিয়ে থাকে ।
৪. আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধব (Relatives & Friends): প্রত্যেক মানুষেরই এমন কিছু আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব থাকে, যারা বিভিন্ন বিপদ-আপদ ও প্রয়োজনের সময় এগিয়ে আসে। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, ব্যবসায়ে অর্থায়নে নিজস্ব তহবিল হতে সংগৃহীত অর্থ অপর্যাপ্ত হলে নিকটতম আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের শরণাপন্ন হয় এবং তাদের কাছ থেকে ঋণ হিসেবে অর্থ নিয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করা হয়। আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ইতিবাচক দিক হচ্ছে কোনো ধরনের জামানত এবং সুদ বা মুনাফা না দিয়েই খুবই সহজ শর্তে ও সহজ প্রক্রিয়ায় ঋণ গ্রহণ করা যায় ।
৫. দেশীয় ব্যাংকার (Indigenous Banks): প্রাচীনকাল হতেই ব্যবসায়ের অর্থসংস্থানে দেশীয় ব্যাংকার মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দেশীয় ব্যাংকার বলতে অর্থ ব্যবসায়ে লিপ্ত বিভিন্ন ব্যক্তি বা মহাজন শ্রেণীকে বুঝায়। দেশীয় ব্যাংকার চড়া সুদে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ঋণ প্রদান করে। গ্রামাঞ্চলে দেশীয় ব্যাংকারদের উপস্থিতি অধিক লক্ষণীয়।
৬. ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি (Management Agent): ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি বলতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় যারা চুক্তির আওতায় কোনো কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এরূপ ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের অন্যতম উৎস। ব্যবস্থাপনা প্রতিনিধি আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত স্বচ্ছল থাকায় খুব সহজেই তারা অর্থের সংস্থান করতে সক্ষম হয়। তাছাড়া বাজারে যথেষ্ট সুনাম থাকায় সহজেই কোম্পানির শেয়ার ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে এবং নিজেদের জিম্মায় ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণ করতে পারে।
৭. সমবায় ব্যাংক ও সমবায় ঋণদান সমিতি (Co-operative Banks & Co-operative Credit Society): সমবায় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন শিল্প, ব্যবসায় ও বাণিজ্যে ঋণ প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ছোটখাটো বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি ঋণ প্রদানের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানের চলতি মূলধনের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। অন্যদিকে সমবায় ঋণদান সমিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হলো সহজ শর্তে বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ঋণ দান করা। অবশ্য এরূপ প্রতিষ্ঠান প্রধানত সদস্যদের ঋণদানের ক্ষেত্রেই অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে ।
৮. অগ্রিম অর্থ (Advance Money): যেসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে বাজারে যথেষ্ট সুনাম রয়েছে তাদের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কেননা, তাদের পণ্য পাওয়ার জন্যে ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, পাইকার, দালাল বা ফড়িয়াগণ অনেক সময় পণ্য উৎপাদন বা সংগ্রহের আগেই অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে থাকে। আবার, কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন শিল্প মালিকদের কাছ থেকে কাঁচামালের অগ্রিম মূল্য পেয়ে থাকে ।
৯. সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান (Government and Semi - Govt. Organizations): সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মসূচি রয়েছে দেশের ব্যবসায় ও শিল্প খাতের উন্নয়নে । কারিগরি সহায়তার পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহদাকার ব্যবসায়ের চলতি মূলধনের চাহিদা নিরসনে স্বল্প মেয়াদি অর্থ সরবরাহ করে থাকে।
১০. ভূমি বন্ধকি ব্যাংক (Land Mortgage Banks): ভূমি বন্ধকি ব্যাংকের কাজ হলো ভূমি বা জমি বন্ধক রেখে ঋণ প্রদান করা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ তাদের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সম্পত্তি বন্ধক রেখে ভূমি বন্ধকি ব্যাংক হতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে থাকে ।
১১. শিল্প ব্যাংক (Industrial Bank): শিল্প ব্যাংক একটি বিশেষায়িত ব্যাংক। এরূপ ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো দেশের শিল্পখাতের উন্নয়নে ঋণ ও পরামর্শ প্রদান করা। শিল্প ব্যাংক মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি শিল্পের চলতি মূলধনের চাহিদা পূরণের জন্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে থাকে ।
১২. ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি (Micro Credit Program): আমাদের দেশের ব্যবসায় ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা (NGO) যেমন–ব্রাক, আশা, প্রশিকা প্রভৃতি গ্রামীণ জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির আওতায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি অর্থের যোগান দিচ্ছে। বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের জামানতবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচিও ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানে কার্যকর ভূমিকা রাখছে ।
১৩. বিল বাট্টাকরণ (Discounting Bills): ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাপ্য বিল বাট্টাকরণের মাধ্যমেও স্বল্পমেয়াদি অর্থের সংস্থান করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রাপ্য বিল কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গিয়ে বিলের লিখিত মূল্যের (Face Value) চেয়ে কম অর্থের সংস্থান করতে পারে। জরুরি প্রয়োজনে এরূপ বিল বাট্টাকরণের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থান করা হয় ।
১৪. সম্পত্তি বিক্রয় (Sale of Assets): অনেক সময় ব্যবসায় কিছু কিছু সম্পত্তি থাকে যা ব্যবসায়ে কাজে লাগে না বা অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়। এরূপ সম্পত্তি বিক্রয় করেও ব্যবসায়ের স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয় ৷
পরিশেষে বলা যায় যে, সকল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানই স্বল্প মেয়াদি বিভিন্ন ধরনের অর্থসংস্থানের উপর নির্ভরশীল। স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস হচ্ছে প্রধানত উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ব্যয়। কর্মীদের পারিশ্রমিক অফিস রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, প্রভৃতি খাতে ব্যয় করা হয়।
দীর্ঘ কালীন সময়ের জন্য অর্থাৎ ৫ বা ১০ বছরের অধিক সময়ের জন্য ব্যবসায়ে যে অর্থসংস্থান করা হয় তাকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান বলে । বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের প্রয়োজন হয় ।
দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎসসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হলো—
১. শেয়ার বিক্রয় (Sale of share): কোম্পানি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করতে পারে। সাধারণত: কোম্পানি বিলোপসাধনের আগে শেয়ারের অর্থ ফেরত দিতে হয় না । বিভিন্ন প্রকার শেয়ারের মাধ্যমে এ ধরনের অর্থসংস্থানের কাজ হয় ।
২. ঋণপত্র বিক্রয় (Sale of debenture): কোম্পানি জনগণের নিকট শেয়ার বিক্রয় করার পাশাপাশি ঋণপত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করতে পারে ।
৩. সঞ্চিতি তহবিল (Reserve fund ): কোম্পানির মুনাফার যে অংশ বণ্টন না করে রেখে দেয়া হয় তাকে সঞ্চিতি তহবিল বলে। এই অবণ্টিত মুনাফা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চিতি তহবিল গঠন করা হয় যা ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস বলে বিবেচিত হয়। যেমন- সাধারণ সঞ্চিতি তহবিল, লভ্যাংশ সমতাকরণ তহবিল ।
৪. অবলেখক (Underwriter): যে সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ের ঝুঁকি গ্রহণ করে তাদেরকে অবলেখক বলে। কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয় করা সম্ভব না হলে অবলেখকরাই চুক্তি অনুযায়ী অবশিষ্ট শেয়ার ও ঋণপত্র ক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে ।
৫. শেয়ার বাজার (Share market): যে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়মিত ও অনুমোদিত ভাবে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ও ঋণপত্র ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাকে শেয়ার বাজার বলা হয়। শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করা যায়।
৬. শিল্পব্যাংক (Industrial bank): শিল্পব্যাংক ও শিল্প ঋণ সংস্থা বৃহদায়তন শিল্প স্থাপন ও উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের কাজ করে থাকে ।
৭. বন্ধকি ব্যাংক (Mortage bank): সাধারণত: বাণিজ্যিক ব্যাংক উপযুক্ত জামানত পেলে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের জন্য ঋণ সরবরাহ করে থাকে। অনেক সময় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে ।
৮. বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান (Investment organisation): বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, বীমা, লিজিং ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করে ।
৯. বীমা প্রতিষ্ঠান (Insurance company): ব্যবসায়ের অনিশ্চয়তা দূর করে ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে বীমা প্রতিষ্ঠান । এরা এদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যবসায়ের দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করে থাকে ।
পরিশেষে বলা যায় যে, যেকোনো ব্যবসায় পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিমাণ মূলধন বা তহবিলের প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদিও হয়। উপরিউক্ত উৎসগুলোর মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করা যায় ।
নতুন কিংবা পুরাতন কোম্পানি সংগঠনের মূলধন সংগ্রহের প্রধান হাতিয়ার হলো শেয়ার। ইংরেজি ‘Share’” শব্দের আভিধানিক অর্থ 'অংশ' । কোম্পানি সংগঠনের ক্ষেত্রে শেয়ার-এর অর্থ হচ্ছে-কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। কোম্পানির মোট মূলধনকে মোট সমপরিমাণ কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভক্ত করা হয়। এদের প্রত্যেকটি একককে এক একটি শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি শেয়ারের নির্দিষ্ট আংকিক মূল্য (Face value) থাকে এবং প্রত্যেকটির মূল্য সমান থাকে। যেমন-কোনো কোম্পানির ১০ লক্ষ টাকার মূলধনকে ১০,০০০ ভাগে ভাগ করা হলে এক একটি ভাগের মূল্য হবে ১০০ টাকা। মূলধনের এ শেয়ারের মালিক হয়ে কোম্পানির মালিকানা দাবি করা যায়। কোম্পানির নির্বাচনে ভোটদানের অধিকার পাওয়া যায়। বৃহদায়তন কোম্পানি চলমান অবস্থায় আর্থিক সংকটে পড়লে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের ব্যবস্থা করে।
সুতরাং কোম্পানির সমগ্র মূলধনকে সমপরিমাণ এককে বিভক্ত করলে প্রত্যেকটি একককে শেয়ার বলে। প্রত্যেকটি এককই সমান মূল্য বহন করে এবং মূলধনের একটি ক্ষুদ্র অংশ নির্দেশ করে, যাকে শেয়ার বলে । পরিশেষে বলা যায় যে, শেয়ার হচ্ছে কোম্পানির মোট মূলধনের অংশ। যে ব্যক্তি শেয়ার ক্রয় করে তাকে শেয়ারহোল্ডার বলে । প্রত্যেকটি শেয়ার মূলধনের অংশ বলে সেটি ক্রয়ের দ্বারা শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির আংশিক মালিকানা লাভ করে এবং এর বলে তারা কোম্পানির লভ্যাংশ পাবার অধিকার লাভ করে। কোম্পানির বিলোপ সাধন ঘটলে শেয়ারহোল্ডারগণ কোম্পানির সম্পত্তিতে প্রদত্ত মূলধনের আনুপাতিক অংশ ফেরত পাবার অধিকারী হয়।
শেয়ার হলো যৌথ মূলধনী কোম্পানির মোট মূলধনের ক্ষুদ্রতম অংশ। কোম্পানি মূলধন সংগ্রহ করার জন্য জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। কোম্পানি নিজের এবং বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করে,বিভিন্ন প্রকার শেয়ার ইস্যু করে।
নিম্নে ছকের মাধ্যমে শেয়ারের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো—
যে শেয়ারের মালিকগণ অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ারের মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর লভ্যাংশ পায় এবং ব্যবসায় বিলোপ সাধনকালেও অগ্রাধিকার যুক্ত শেয়ার মালিকদের মূলধন দেয়ার পর তাদের মূলধন ফেরত পাবার অধিকারী হয় তাকে সাধারণ বা ইক্যুইটি শেয়ার বলে ।সাধারণ শেয়ারের লভ্যাংশের হারের কোনো স্থিরতা নেই। লাভ বেশি হলে লভ্যাংশ বেশি হবে আর লাভ কম হলে তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশও কম হবে। সাধারণ শেয়ারকে ইক্যুইটি শেয়ার বলা হয়। এ ধরনের শেয়ার মালিকগণ পূর্ণ ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন এবং ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ।
যে শেয়ারের মালিকগণ ব্যবসায়ের লভ্যাংশ বণ্টনের ক্ষেত্রে বা ব্যবসায়ের বিলোপ সাধনের সময়ে তাদের মূলধনের অর্থ ফেরত পাবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারলাভ করে থাকেন তাকেই বলে অগ্রাধিকারযুক্ত শেয়ার । কোম্পানি আইনের ৮৫ নং ধারায় বলা আছে যে, অগ্রাধিকার শেয়ার হলো কোম্পানির শেয়ার মূলধনের সেই অংশ যা নিরূপ সুবিধাসমূহ ভোগ করে থাকে :
(ক) লভ্যাংশ বণ্টনের সময় এ শেয়ারের নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পাবার অগ্রাধিকার থাকে।
(খ) কোম্পানি বিলোপ হলে মূলধন ফেরত দেবার অগ্রাধিকার থাকতে পারে ।
লভ্যাংশ বণ্টন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অগ্রাধিকার শেয়ারকে আবার কতিপয় শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—
i. সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Cumulative Preference Share): যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে কোম্পানি তাদের লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ হয় । তবে তাদের অপরিশোধিত লভ্যাংশ বকেয়া রেখে পরে যখন কোম্পানি মুনাফা অর্জিত হয় তখন বর্তমান লভ্যাংশের সাথে পূর্বের অপরিশোধিত বকেয়া লভ্যাংশ পরিশোধ করে দেয়া হয়। অপরিশোধিত লভ্যাংশ কোম্পানির কাছ পাওনা হতে থাকে এবং মুনাফা অর্জিত হলে কোম্পানি তা প্রদান করে। এ ধরনের শেয়ারকে সঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলা হয়ে থাকে ।
ii. অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Cumulative Preference Share): এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকগণ কেবলমাত্র যে বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত হয় সে বছরই লভ্যাংশ পাবার অধিকারী হয়। যদি কোনো বছর কোম্পানির মুনাফা অর্জিত না হয় তাহলে তারা কোম্পানির কাছে ঐ বছরের মুনাফা দাবি করতে পারে না এবং এরূপ মুনাফা কোম্পানির কাছে তাদের পাওনা হয় না। এ কারণে এরূপ শেয়ারকে অসঞ্চয়ী অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
iii. পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Redeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে শেয়ার মালিকদের ফেরত দেয়া হয় তাকে পরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে। এরূপ শেয়ার কেবল পরিমেল নিয়মাবলির অনুমোদনক্রমে কোম্পানি আইনের শর্ত অনুযায়ী বিক্রয় করা চলে। এটি মূলত শেয়ার ও ঋণপত্রের মিশ্রিত এক বিশেষ ধরনের শেয়ার।
iv. অপরিশোধ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Irredeemable Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মূল্য কোম্পানির বিলোপ সাধনের পূর্বে ফেরৎ পাওয়া যায় না তাকে অপরিশোধ্য শেয়ার বলে ।
v. অংশগ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Participating Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারের মালিকগণ মুনাফা হতে প্রথমত নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ প্রাপ্ত হলেও পরবর্তীতে সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় তার অংশ পায় তাকে অংশগ্রহনকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vi. অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Participating Preference Share): যে জাতীয় শেয়ারের মলিকগণ মুনাফা হতে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট হারে লভ্যাংশ পায় কিন্তু সাধারণ শেয়ার মালিকদের মাধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের সময় পুনরায় অংশ পায় না তাকে অংশ না গ্রহণকারী অগ্রাধিকার শেয়ার বা নন পার্টিসিপেটিং শেয়ার বলে ।
vii. পরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Convertible Preference Share ) : শেয়ার বিক্রয়ের শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ান্তে যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ দেয়া হয় তাকে পরিবর্তনযোগ্য শেয়ার বলে ।
viii. অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার (Non-Convertible Preference Share): যে অগ্রাধিকার শেয়ারকে কখনই সাধারণ শেয়ারে রূপান্তরিত করা যায় না তাকে অপরিবর্তনযোগ্য অগ্রাধিকার শেয়ার বলে ।
অগ্রাধিকার শেয়ার ও সাধারণ শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টনের পর এ শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মধ্যে লভ্যাংশ বণ্টন করা হয়। আবার কোম্পানির বিলোপ সাধনের ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত দুই শ্রেণীর শেয়ার মালিকদের মূলধনের অর্থ প্রত্যার্পণ করার পর যদি মূলধনের বা সম্পত্তির কোনো উদ্বৃত্ত থাকে তাহলে তাদের দাবি মেটানো হয়। কাজেই কোম্পানির লভ্যাংশ বণ্টন বা মূলধন প্রত্যর্পণের বিষয়ে এরা সর্বশেষ দাবিদার বা অধিকারভোগী। কোম্পানির প্রবর্তক বা উদ্যোক্তারাই এ শ্রেণীর শেয়ারের মালিক হয়। এ ধরনের শেয়ারকে প্রবর্তকের শেয়ার বা Founder's Share বলে।
সাধারণভাবে উপরে বর্ণিত তিন ধরনের শেয়ার দেখা যায়। তবে অনেক সময় কোম্পানিকে উপরের শেয়ারগুলো ছাড়াও বিভিন্ন নামে শেয়ার বণ্টন করতে দেখা যায়। বৈশিষ্ট্যের দৃষ্টিতে এ শেয়ারগুলো সাধারণ শেয়ার ।
নিম্নে তিন ধরনের বিশেষ শেয়ারের বর্ণনা দেয়া হলো—
ক. অধিবৃত্তি/বোনাস শেয়ার (Bonus Share): কখনও কখনও কোম্পানি অর্জিত মুনাফার কিছু কিছু অংশ সদস্যদের মধ্যে বণ্টন না করে কোম্পানির উন্নয়নের জন্য সংরক্ষিত তহবিলে তা জমা রাখে । তহবিলে রক্ষিত এই অবণ্টিত মুনাফা থেকে সৃষ্ট লভ্যাংশ পরবর্তীতে শেয়ার মালিকগণকে নগদে প্রদান না করে ঐ লভ্যাংশের বদলে কোম্পানি শেয়ার ইস্যু করে। নগদ লভ্যাংশের বদলে যে শেয়ার ইস্যু বা প্রদান করা হয় সেই শেয়ারকে অধিবৃত্তি বা বোনাস শেয়ার বলে। এ শেয়ারকে বিশেষ ধরনের শেয়ার বলা হলেও এ শেয়ার সাধারণ শেয়ারের অন্তর্গত। বোনাস শেয়ারের আংকিক মূল্য নগদে শেয়ার মালিকগণকে না দিয়ে তা সংরক্ষিত তহবিল থেকে মূলধন তহবিলে রূপান্তর করা হয়।
খ. অধিকার বা রাইট শেয়ার (Right Share): প্রয়োজনের তাগিদে অধিকতর মূলধন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কোম্পানি আবার নতুন করে শেয়ার বাজারে ছাড়ার সময় বর্তমান শেয়ার মালিকদেরকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বর্তমান (existing) শেয়ার মালিকগণ তাদের অধিকারভুক্ত পূর্বে ক্রীত শেয়ারের অনুপাতে নতুন শেয়ার ক্রয়ের অধিকারী হয়। অধিকার প্রাপ্ত এ নতুন শেয়ারকে রাইট শেয়ার বলে। মনে করা যাক, কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ২:১ অনুপাতে রাইট শেয়ার ইস্যু করবে। অর্থাৎ যার পুরাতন ২টি শেয়ার আছে সে ১টি নতুন শেয়ার ক্রয়ের রাইট শেয়ার হিসেবে পাবে। রাইট শেয়ারও কোনো পৃথক ধরনের শেয়ার নয় । এটি সাধারণ বা অগ্রাধিকার শেয়ার হতে পারে।
গ. অনির্ধারিত মূল্য বা অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার (No-par value Shares): যে শেয়ারের কোনো আঙ্কিক মূল্য পূর্ব হতে নির্দিষ্ট থাকে না, বছর শেষে হিসাব-নিকাশের পর মোট সম্পদ হতে মোট অন্যান্য দায়ের পরিমাণ বাদ দিয়ে শেয়ারের মূল্যমান নিরূপণ করা হয়, তাকে অনাঙ্কিক মূল্যের শেয়ার বলে। আমাদের দেশে এ ধরনের শেয়ারের প্রচলন নেই। আমেরিকায় এ ধরনের শেয়ার বেশি দেখা যায়। প্রবর্তক বা উদ্যোক্তাগণ এ শেয়ারের মালিক হয় ।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের শেয়ারের ব্যবহার ঘটায় শেয়ারহোল্ডারগণ তাদের প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী এসব শেয়ার ধারণ করেন। উপরের আলোচনায় বিভিন্ন ধরনের শেয়ার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ।
ঋণপত্র হলো ঋণের দলিল। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির অর্থ সংগ্রহের অন্যতম হাতিয়ার এ ঋণপত্র। ঋণপত্রের মাধ্যমে কোম্পানি একদিকে অর্থ সংগ্রহ করে অন্যদিকে অর্থ প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময়ে সুদ প্রাপ্তির মাধ্যমে আয়ের বিষয় নিশ্চিত হয় । যারা ঋণপত্র ক্রয় করে তাদেরকে কোম্পানির পাওনাদার বলে ।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি স্বীয় সীলমোহরযুক্ত যে দলিলের সাহায্যে একটি নির্দিষ্ট হারে প্রতিবছর সুদ প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে জনগণের নিকট থেকে ঋণ হিসেবে মূলধন সংগ্রহ করে তাকে ঋণপত্র বলে । ঋণপত্রে কোম্পানির নামযুক্ত সীলমোহর থাকে। এর উপর প্রদেয় সুদ, জামিন, পরিশোধের সময় প্রভৃতি শর্তাবলির উল্লেখ থাকে। শেয়ারের মতো এরও একটি আঙ্কিক মূল্য থাকে। উল্লেখ্য যে, কোম্পানি আইন অনুযায়ী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ঋণপত্র বিলি করে ঋণ সংগ্রহ করতে পারে। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ঋণপত্র বিক্রি করতে পারে না ।
ঋণপত্রের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Debenture)
ঋণপত্রকে ঋণের দলিল বলা হয়। কোম্পানির মূলধন গঠনের জন্য এ দলিলটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে । সুতরাং, ঋণপত্র বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। ঋণের জামানত, ঋণ পরিশোধের শর্ত, হস্তান্তর ও পরিবর্তনের সুযোগ, সুবিধা ইত্যাদির ভিত্তিতে ঋণপত্রকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। কোম্পানির ঋণ দাতারা সুযোগ এবং চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান করে থাকে ।
ঋণপত্রকে নিােক্ত শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়—
১. সাধারণ বা জামানত বিহীন ঋণপত্র (Ordinary or Unsecured Debenture): যে ঋণপত্র বিলি করতে কোম্পানিকে কোনো প্রকারের জামিন দিতে হয় না তাকে সাধারণ বা জামানত বিহীন ঋণপত্র বলে। এ জাতীয় ঋণপত্রে শুধু ঋণের টাকা ও সুদ প্রদানের প্রতিশ্রুতি থাকে। বাজারে কোম্পানির যথেষ্ট সুনাম থাকলে তার উপর ভিত্তি করে জনসাধারণ জামিন ছাড়াই এরূপ ঋণপত্র ক্রয় করে থাকে। সুনামই ক্রেতার কাছে জামানত হিসেবে কাজ করে। এরূপ ঋণপত্রের মালিকগণ কোম্পানির সাধারণ পাওনাদার বলে বিবেচিত হন।
২. বন্ধকী বা জামানতযুক্ত ঋণপত্র (Mortgage or Secured Debenture): ব্যবসায়ের কোনো সম্পত্তি বন্ধক রেখে বা জামিন রেখে কোম্পানি যেসব ঋণপত্র ইস্যু করে, সেগুলোকে বন্ধকী ঋণপত্র বলা হয়। এতে কোম্পানির ঋণগ্রহীতাগণ ঋণের আসল ও সুদ পাওয়ার নিশ্চয়তা লাভ করে। এ জাতীয় ঋণপত্র বিলির ক্ষেত্রে কোম্পানিকে ঋণপত্রের জামানতকৃত সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে নিবন্ধকের কাছে জানাতে হয় ।
বন্ধকী/জামানতযুক্ত ঋণপত্রকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করা যায়:
৩. নিৰ্দিষ্ট জামানত যুক্ত ঋণপত্র (Fixed Charge Debenture): কোম্পানির বিশেষ সম্পদের উপর জামিন রেখে যে ঋণপত্র বিলি করা হয় তাকে বলে নির্দিষ্ট জামানতযুক্ত ঋণপত্র। এসব ক্ষেত্রে ঋণপত্রধারীদের অনুমতি ছাড়াই লেনদেন করে থাকে ।
১. পরিশোধ্য ঋণপত্র ( Redeemable Debenture): নির্দিষ্ট সময় শেষে ঋণ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সব ঋণপত্র কোম্পানি ইস্যু করে থাকে সেগুলোকে বলে পরিশোধ্য ঋণপত্র। সাধারণভাবে ঋণপত্রে উল্লেখিত শর্তানুসারে এরূপ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হয়।
২. অপরিশোধ্য ঋণপত্র (Irredeemable Debenture): যে ঋণপত্রের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ থাকে না এবং ঋণপত্রধারিগণ তাদের প্রদত্ত অর্থ দাবি করতে পারে না তাকে অপরিশোধ্য ঋণপত্র বলে। এরূপ ঋণপত্রকে চিরস্থায়ী ঋণপত্র বলে ।
১. নিবন্ধিত ঋণপত্র ( Registered Debenture): যে ঋণপত্রে ক্রেতার নাম কোম্পানির বইতে লিপিবদ্ধ থাকে তাকে নিবন্ধিত ঋণপত্র বলে। এ ধরনের নিবন্ধন পত্রে ক্রেতার নাম, ক্রমিক নম্বরসহ উল্লেখ থাকে। হস্তান্তর দলিল সম্প্রদান করে এ ধরনের ঋণপত্রের ধারক সংশ্লিষ্ট ঋণপত্র কোম্পানিকে জানিয়ে বিক্রি করতে পারে ।
২. অনিবন্ধিত ঋণপত্র (Un- Registered Debenture): যে ঋণপত্রে ক্রেতার নাম এবং এর বিলিকারী কোম্পানির বইতে লিপিবদ্ধ থাকে না তাকে অনিবন্ধিত ঋণপত্র বলে। এ ঋণপত্রে ক্রেতার নাম ও ক্রমিক নম্বর উল্লেখ থাকে না। এ ধরনের ঋণপত্র হস্তান্তরের জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না ।
১. রূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র (Convertible Debenture): শর্তানুসারে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ঋণপত্রের মালিকগণ ইচ্ছা করলে তাদের ঋণপত্রকে শেয়ারে রূপান্তর করতে পারে। এ ধরনের ঋণপত্রকে পরিবর্তনীয় বা রূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র বলে ।
২. অরূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র (Unconvertible Debenture): যে ঋণপত্রকে কখনই শেয়ারে রূপান্তর করা যায় না তাকে অরূপান্তরযোগ্য ঋণপত্র বলে। কেবল অর্থের মাধ্যমে এ ঋণপত্রের টাকা পরিশোধ করা হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায় যে, কোম্পানি জগতে বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্রের ব্যবহার ব্যাপক। বিভিন্ন ধরনের ঋণপত্র কোম্পানির অর্থায়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে।
বিলোপসাধন বলতে গুটিয়ে ফেলা বা বিলুপ্ত করা বা বন্ধ করে দেয়াকে বোঝায়। আর কোম্পানির বিলোপসাধন বলতে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়াকে বোঝায়। যে পদ্ধতিতে কোম্পানির কার্যক্ষমতার অবসান ঘটে তাকে কোম্পানির বিলোপসাধন বলে ।
কোম্পানি আইন-সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী একটি স্বেচ্ছা সংগঠন। আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট বলে এর পরিসমাপ্তিও আইনের মাধ্যমেই হয়ে থাকে ।
১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের নিয়ম মোতাবেক কোম্পানির কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলাকে ই কোম্পানির বিলোপসাধন বলে । আইনের বিধান পালনের মাধ্যমে কোম্পানির কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া যায়। আর এর মাধ্যমেই কোম্পানি হারায় তার অস্তিত্ব।
কোম্পানি আইনের বিধান অনুযায়ী কোনো কোম্পানির কাজকর্ম গুটিয়ে নেয়ার পদ্ধতিকে কোম্পানির বিলোপসাধন বলে। ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২৩৪(১) ধারায় কোম্পানির বিলোপসাধনের তিনটি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে।
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার, পাওনাদার বা কোম্পানির নিবন্ধকের আবেদনের প্রেক্ষিতে যে সব কারণে আদালত কর্তৃক বাধ্যতামূলক বিলোপসাধন হতে পারে, সেগুলো হলো-
১. বিশেষ সভায় শেয়ারহোল্ডারগণ কর্তৃক বিলোপ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
২. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিধিবদ্ধ সভা অনুষ্ঠান ও নিবন্ধকের নিকট বিধিবদ্ধ বিবরণী পেশে ব্যর্থতা;
৩. নিবন্ধনের এক বছর সময়ের মধ্যে কার্যারম্ভে ব্যর্থতা;
৪. যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত এক বছর সময়ের বেশি কার্যক্রম বন্ধ থাকা;
৫. আইন মোতাবেক কোম্পানিতে ন্যূনতম সংখ্যক সদস্য না থাকা;
৬. কোম্পানির পাঁচ হাজার টাকা বা তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা ;
উল্লেখিত যেকোনো কারণে আদালত অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়ে একজন লিকুইডিটর নিয়োগ করতে পারেন, যিনি কোম্পানির সব সম্পত্তি হতে প্রথমে তৃতীয় পক্ষের দেনা পরিশোধ করে কিছু থাকলে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন করেন।
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা পাওনাদারগণ ইচ্ছে করলে নিজেরাই কোম্পানির অবসায়ন ঘটাতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডার ও পাওনাদারগণ পারস্পরিক যোগাযোগের ভিত্তিতে আদালতের সাহায্য ছাড়াই স্বেচ্ছায় বিলোপসাধন ঘটাতে পারেন।
যেসব কারণে কোম্পানির স্বেচ্ছায় বিলোপসাধন ঘটাতে পারে তা হলো [২৯০(১) ধারা] :
i. বিশেষ সভায় শেয়ারহোল্ডারগণ ও পাওনাদারবৃন্দের বিলোপসাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ;
ii. কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে ও সময়ের জন্য কোম্পানি গঠিত হয়ে তা সম্পন্ন হলে;
iii. কোম্পানি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে এবং পরিশোধে অক্ষম হলে;
iv. কোম্পানি পরিচালনা অলাভজনক হলে ইত্যাদি।
কোম্পানির স্বেচ্ছামূলক বিলোপসাধনের ক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের তত্ত্বাবধানে বিলোপসাধন ঘটতে পারে। যেসব কারণে এরূপ বিলোপসাধন ঘটে। সেসব হলো :
i. শেয়ার মালিক বা পাওনাদারদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে বিলোপ সাধনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে;
ii. কোম্পানির সম্পদ সংগ্রহ ও বিক্রয়ে অনিয়ম হলে; ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন পন্থায় কোম্পানির অবসান ঘটানো যায়। এগুলো ছাড়া যেকোনো যৌক্তিক কারণে আদালত যেকোনো কোম্পানির বিলোপ সাধন ঘটাতে পারে ।
প্রায় ১৫ কোটি মানুষের দেশ হওয়ায় এদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার মোটামুটি বড়। তদুপরি সস্তা জনশক্তির কারণে এ দেশের অনেক বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশে বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি সংগঠন বিস্তার লাভ করতে পারে নি। এর পিছনে অন্তরায়সমূহ নিম্নরূপ—
১. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব (Insufficiency of efficient entrepreneurs): এ ধরনের ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলার জন্য একদল দক্ষ, অভিজ্ঞ ও আন্তরিক উদ্যোক্তা শ্রেণী আবশ্যক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ দেশে তার অভাব রয়েছে।
২. দক্ষ ও পেশাদার ব্যবস্থাপকের অভাব (Insufficiency of shilled and professional managers): কোম্পানি প্রতিষ্ঠানের বিশেষত বৃহদায়তন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির পরিচালনা পদ্ধতি জটিল হওয়ায় এর পরিচালনায় একদল দক্ষ ও পেশাদার ব্যবস্থাপকের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থাপকের যথেষ্ট অভাব লক্ষণীয়।
৩. পরিচালকদের ইতিবাচক মনোভাবের অভাব (Lack of the positive mentality of directors): আমাদের দেশের অনেক কোম্পানি পরিচালকের ব্যবসায় পরিচালনায় ইতিবাচক মনোভাবের যথেস্ট অভাব লক্ষণীয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করা, শেয়ারের দাম বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি মানসিকতা সবাইকে হতাশ করে ।
৪. পরিচালনা ব্যয়ের আধিক্য (Excess management expenses): পরিচালকসহ এর উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যবস্থাপকের মধ্যে অধিক ব্যয় করার হীন মানসিকতাও লক্ষণীয়। শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব থেকে এ ধরনের মানসিকতার সৃষ্টি হয়, যা সবাইকে হতাশ করে ।
৫. শক্তি সম্পদের অভাব (Lack of energy): বৃহদায়তন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার জন্য বর্তমানকালে শক্তি সম্পদের প্রাচুর্যতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতের দুরবস্থা এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠনে উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করে।
৬. কার্যকর দৃষ্টান্তের অভাব (Absence of effective instance) : পৃথিবীর দেশে দেশে লক্ষণীয় যে, একটা উদ্যোক্তা গ্রুপ দেশে বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে। যাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে অন্যরা এগিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এই দৃষ্টান্তের বড়ই অভাব রয়েছে।
৭. কার্যকর ব্যবসায় পরিবেশের অনুপস্থিতি (Absence of effective business environment): আমাদের দুর্ভাগ্য হলো এই যে, দেশে ব্যবসায়ের কার্যকর কোনো পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। পাট, চামড়া ইত্যাদি শিল্প এক সময় এগুলেও পরবর্তীতে তা স্থায়ী হয়নি। সরকারের জাতীয়করণ নীতিও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সফল হয়নি। চোরাকারবারীও এক সময় ব্যবসায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
৮. শক্তিশালী শেয়ার বাজারের অনুপস্থিতি ( Absence of sound share market): যে কোনো দেশেই বৃহদায়তন কোম্পানি সংগঠন প্রতিষ্ঠায় শেয়ার বাজার নেতৃত্ব দেয়। এই বাজারের কারণে ক্ষুদ্ৰ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে শেয়ার বাজার ফটকাবাজদের অভায়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় এর সুফল কোম্পানিগুলো পাচ্ছে না।
মোটকথা বাংলাদেশে কোম্পানি সংগঠন এগিয়ে নেওয়ার মত পরিবেশ কার্যত সৃষ্টি হয়নি। নানান প্রতিকূল পরিবেশ দূরীকরণে যাদের উদ্যোগী হওয়ার কথা তাদের ভূমিকাতে বিনিয়োগকারীর অসন্তুষ্ট। তাই নানান প্রতিশ্রুতি আর কথার ফুলঝুরি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
বায়িং হাউজ ব্যবসায় ( Buying House Business) :
বর্তমানে দেশে পোশাক তৈরী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। বিদেশ থেকে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারনত সরাসরি কোনো তৈরী পোশাক শিল্পে প্রতিষ্ঠানের সংঙ্গে যোগাযোগ করে না। তারা পণ্য কিনতে তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেয়। দু'পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ধরনের পণ্য সরবরাহ করার যাবতীয় দায়িত্বপালন করে । এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বায়িং হাউজ ব্যবসায় বলে ।
বায়িং হাউজ ব্যবসায় দিতে হলে লাগবে এ ব্যবসার বৈধ সনদ। এ জন্য প্রথমেই-
১. ট্রেড লাইসেন্স করে নিতে হবে।
২. BGMEA এর সদস্যপদ পেতে আবেদন করতে হবে।
আবেদনপত্রের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্সের কপি, মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেল বা অংশীদারি দলিলের কপি, পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি, ভাড়ার চুক্তিপত্র বা ক্রয় দলিল, ট্যাক্স সার্টিফিকেটের কপি, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যয়নপত্র (যদি থাকে) বিনিয়োগ বোর্ডের ওয়ার্ক পার্মিট প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে স্বাক্ষর সহ জমা দিতে হবে। বায়িং হাউজের জন্য নিবন্ধন ফি ১৫ হাজার টাকা। এক বছরের সদস্য ফি ৮ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে জমা দিতে হবে ২৩ হাজার টাকা। BGMEA এর নির্ধারিত ব্যাংক হিসাব নম্বরে এ টাকা জমা দিতে হবে। সদস্যপদ নবায়নের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে সহযোগী সদস্য হিসেবে একবছরের জন্য সনদ দেয়া হয়। ফলে এক বছর পর সনদ নবায়ন করে নিতে হবে।
বর্তমানে দেশে BGMEA এর সদস্যভুক্ত বায়িং হাউজের সংখ্যা ৯১১টি এবং BGBA এর ১৭৯টি। এ দুই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত নয় এমন বায়িং হাউজ রয়েছে প্রায় ৮ শত। অর্থাৎ সবমিলিয়ে দেশে বায়িং হাউজের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার।
শেয়ারবাজার বা স্টক এক্সচেঞ্জ (Stock Exchange)
স্টক এক্সচেঞ্জ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শেয়ার বাজার সম্পর্কে ধারণা করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে শেয়ার ও বাজার সম্পর্কে । অর্থাৎ—
শেয়ার বাজার হচ্ছে এমন একটি সংগঠিত মাধ্যমিক বাজার যেখানে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি গুলো শেয়ার, স্টক বা সিকিউরিটি নির্ধারিত নিয়মে ক্রয়-বিক্রয় করার প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে ।
ক্ষুদ্র ঋণ (Micro Credit)
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষ ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু প্রায়ই বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো সমাজের গরিব শ্রেণীর মানুষকে ঋণ দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। আর এই গরীব শ্রেণীর মানুষকে ঋণ প্রদানের উদ্দেশ্যেই ক্ষুদ্র ঋণের উদ্ভব।
সাধারন অর্থে ক্ষুদ্র ঋণ বলতে বুঝায়, বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণীর মানুষকে অল্প পরিমাণ ঋণ প্রদান করাকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে ক্ষুদ্র ঋণ বলতে বুঝায়, সঞ্চয়, ঋণ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিসেবা বা উৎপাদন, যার সামান্য পরিমাণে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ, শহর বা শহরতলির মানুষদের অর্থনৈতিক এবং জীবন ধারনের মান উন্নয়নে সাহায্য করতে পারবে আর ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা হল সেই সংস্থা যারা এই ধরনের অনুদান দিয়ে থাকে ।
ক্ষুদ্র ঋণ ধারণাটি সর্বপ্রথম আনেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ডঃ মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি ১৯৭৬ সালে সর্ব প্রথম তার নিজ গ্রাম জুবরায় পরীক্ষামূলক ভাবে এই ঋণ চালু করেন। পরবর্তীতে এটির সাফল্যের কারণে ১৯৮৩ সালে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষুদ্র ঋণের প্রচলন শুরু হয়। তাই ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ৮০০ এর উপর ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাক বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষুদ্র ঋণকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য জাতিসংঘ ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণের বছর হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
বিকাশ (Bkash)
বাংলাদেশের প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড ব্র্যাক ব্যাংকের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্প্রতি কার্যক্রম শুরু করেছে। মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা জনসাধারণের কাছে আর্থিক সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিকাশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিকাশের প্রধান সুবিধা হচ্ছে, এটি টাকা পাঠানোর জন্য নিরাপদ, সুবিধাজনক একটি মাধ্যম । ব্র্যাক ব্যাংক ও যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মানি ইন মোশন এর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিকাশের মাধ্যমে ব্র্যাক ব্যাংক কোডবদ্ধ ভিসা টেকনোলজি প্লাটফর্ম ব্যবহার করে, তাই এটি অনেক নিরাপদ ।
বিকাশের মাধ্যমে একজন গ্রাহক অতি দ্রুত টাকা পাঠাতে পারে। এই জন্য বিকাশ পয়েন্টে গিয়ে যেখানে টাকা পাঠাতে চায় সেই মোবাইল নম্বর জানাতে হবে। তারপর বিকাশ পয়েন্ট থেকে ঐ ফোন নম্বরে মেসেজের মাধ্যমে টাকা পৌছে যাবে। মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথে গ্রাহককে টাকা পরিশোধ করা হয়। এইজন্য অবশ্য নির্দিষ্ট হারে চার্জ দিতে হয়।
আউটসোর্সিং ব্যবসা (Outsourcing Business)
আউটসোর্সিং তথা ফ্রিল্যান্সিং শব্দের মূল অর্থ হল মুক্ত পেশা। অর্থাৎ মুক্তভাবে কাজ করে আয় করার পেশা । ইন্টারনেট ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কাউকে দিয়ে এসব কাজ করানোকে আউটসোর্সিং বলে। যারা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দেন তাদেরকে
ফ্রি-ল্যান্সার বলে ।
আউটসোর্সিং ব্যবসায়ের কাজগুলো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা থাকে। যেমন: ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও তথ্যব্যবস্থা, লেখা ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহায়তা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা, বিক্রয় ও বিপণন, ব্যবসাসেবা ইত্যাদি। এইসকল কাজগুলি ইন্টারনেট ব্যবসায়ের মাধ্যমে করে
দিতে পারলেই অনলাইনে আয় করা সম্ভব ।
আউটসোর্সিং এর কাজ পাওয়া যায় এমন অনেক ওয়েবসাইট আছে। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সাইট হলো- www.odesk.com, www.elance.com, www.vworker.com ইত্যাদি ।
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসা (Data Entry Business)
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায় হল কম্পিউটারের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডাটা এক স্থান/প্রোগ্রাম থেকে অন্য আরেকটি স্থান/প্রোগ্রাম এ প্রতিলিপি তৈরি করা । ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে মূলত অনলাইন এবং অফলাইন ভিত্তিক দুটি উপায়ে কাজের সুযোগ রয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক কাজে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি ডাটাসমূহ প্রদান করতে হবে এবং অফলাইনে প্রদানকৃত ডাটাসমূহ নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী সম্পাদন করতে হবে।
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে প্রয়োজনীয় দক্ষতা—
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়:
i. দ্রুত টাইপ করার ক্ষমতা
ii. মাইক্রোসফট অফিসের উপর পরিপূর্ণ দখল
iii. ইংরেজিতে ভাল জ্ঞান
iv. ইন্টারনেটে সার্চ করার দক্ষতা
v. বিভিন্ন ধরনের ওয়েবসাইট, ফোরাম, ওয়েব ডিরেক্টরি সম্পর্কে ভালো ধারনা
ডাটা এন্ট্রি ব্যবসায়ে বাংলাদেশের অবস্থান পূর্বের তুলনায় দিনদিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। উন্নত বিশ্বেও দেশগুলো তাদেও ডাটা-এন্ট্রির কাজগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশ যদি ডাটা-এন্ট্রির বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করে তবে স্বল্প প্রশিক্ষণে প্রচুর কর্মসংস্থান এবং আয় করা যাবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।
কল সেন্টার (Call Center)
কল সেন্টার হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। কল সেন্টারগুলো বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এসব কোম্পানির সুযোগ-সুবিধা, কার্যক্রম প্রাহকদের টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে জানায়। অর্থাৎ, কোন কোম্পানি তার গ্রাহকসেবা সম্পর্কিত তথ্য জনসাধারনকে জানানোর জন্য অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়। আর এই দায়িত্বপালনকারী প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে কল সেন্টার।
কল সেন্টারে কাজ হয় দুইভাবে। একটি ইন বাউন্ড কল এবং অন্যটি আউট বাউন্ড কল। ইন বাউন্ড কলের মাধ্যমে ভোক্তার নির্দিষ্ট কোম্পানি বিষয়ক যেকোন প্রশ্নের সমাধান বলে দেয়া হয়। আর আউট বাউন্ড কলের মাধ্যমে কোম্পানির পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা হয়। এছাড়া ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট, পরামর্শ, ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট, হিসাব সংরক্ষণ, ডকুমেন্ট স্ক্যানিং, ই-পাবলিশিং ইত্যাদি কাজও কল সেন্টারের মাধ্যমে করা হয় । কল সেন্টারগুলো দেশি অথবা বিদেশি দু'ধরনের কোম্পানির হয়েই কাজ করে । যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ পেশা নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে। এমনি একটি নতুন পেশার ক্ষেত্র কল সেন্টার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এজন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেবার উদ্যোগও নিয়েছে। সম্ভাবনাময় এ পেশায় রয়েছে কাজের বিশাল সুযোগ ।
কুরিয়ার সার্ভিস (Couriar Service)
সরকারি ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি যে মাধ্যমের সাহায্যে দ্রুত ও বিশ্বস্ততার সাথে চিঠি পত্র ও মালামাল একস্থান হতে অন্যস্থানে প্রেরণ করা হয় তাকেই কুরিয়ার সার্ভিস বলে। মূলত ডাক বিভাগের ব্যর্থতা ও অপ্রতুলতার কারনেই এই ব্যবস্থার উদ্ভব।
ইংরেজি কুরিয়ার (Courier) শব্দের অর্থ দ্রুত বা সংবাদবাহক আর সার্ভিস শব্দের অর্থ হল সেবা। সুতরাং শাব্দিক অর্থে কুরিয়ার সার্ভিস বলতে সংবাদ আদান-প্রদানের বাহক হিসেবে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। ব্যপকভাবে কুরিয়ার সার্ভিস বলতে ডাক বিভাগের পাশাপাশি বেসরকারি এমন প্রতিষ্ঠানকে বুঝায় যারা বাহক আইনের অধিনে চিঠি পত্র, দলিল দস্তাবেজ, জরুরি ডকুমেন্টস, বিভিন্ন মালামাল ও উপহার সামগ্রী ইত্যাদি বিশ্বস্ততার সাথে দ্রুতগতিতে প্রাপকের নিকট পৌছে দিয়ে থাকে।
১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে DHL নামক একটি কুরিয়ার সার্ভিস যাত্রা শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়ার ৩ বন্ধু Adrin Dalsey Larry, Hilbolm ও Robert Lay মিলে দ্রুত সংবাদ ও তথ্য আদান- প্রদানের জন্য নামক কুরিয়ার সার্ভিস চালু করেন। তিন বন্ধুর নামের অদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত DHL নামক কুরিয়ারটি ছিল পৃথিবীর প্রথম কুরিয়ার। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে DHL নামক এ কুরিয়ারটি বর্তমানে নিজস্ব এয়ারপোর্ট ও বিমানের সহযোগিতায় প্রায় ১১৮টি দেশে সেবা প্রদান করে চলেছে। DHL এর সাথেই তাল মিলিয়ে চলছে আরেকটি আন্তর্জাতিক মানের কুরিয়ার সার্ভিস FedEx। উন্নত বিশ্বের ন্যায় এরপর বাংলাদেশেও DHL এবং FedEx কুরিয়ারের পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন কুরিয়ার যেমন কন্টিনেন্টাল, সুন্দরবন কুরিয়ার, বৈশাখী, পাইওনিয়ার, সেন্ট্রাল, ড্রিমল্যান্ড, ডলফিন, করতোয়া ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার সাথে তথ্য আদান-প্রদান করে চলেছে। বাংলাদেশের কুরিয়ারগুলো শুধু জেলা শহর, কিছু উন্নত যোগাযোগ সমৃদ্ধ থানায় তাদের কার্যক্রম সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টায় তথ্য পরিবেশন করে থাকে।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (Sundarban Courier Service)
বাংলাদেশের প্রথম এবং দ্রুত কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস। বাংলাদেশ বিমান যখন তার এয়ার এক্সপ্রেস সার্ভিস বন্ধ করে দেয় তখন ১৯৮৩ সালে বেসরকারিভাবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস হচ্ছে বাংলাদেশ কুরিয়ার সার্ভিস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। এর কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত। এটি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে দ্রুত ও পার্সেল সার্ভিস প্রদান করে থাকে।
কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিস (Continantal Courier Serive)
কন্টিনেন্টাল সার্ভিস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে মানুষের বিভিন্ন পার্সেল সংশ্লিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে থাকে। এটি কন্টিনেন্টাল গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৩ সালে এটি তার বাণিজ্যিক কার্যক্রম আরম্ভ করে। এর এজেন্সীর সংখ্যা ১৫,০০০ এবং সার্ভিস পয়েন্ট ৫০,০০০। কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের মার্কেট শেয়ার এবং সেবার গুনাগুন অন্যান্য কোম্পানি থেকে ভিন্ন। তাই এটিকে কুরিয়ার সার্ভিসের অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয় । এটির প্রধান অফিস ঢাকার আরামবাগে অবস্থিত।
সফটওয়্যার উন্নয়ন (Software Development)
কম্পিউটার সফটওয়্যার বলতে একগুচ্ছ কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কর্মপদ্ধতি ও ব্যবহার বিধিকে বোঝায়, যার সাহায্যে কম্পিউটারে কোন নির্দিষ্ট প্রকারের কাজ সম্পাদন করা যায়। সফটওয়্যার প্রধানত তিন প্রকার –
i. সিস্টেম সফটওয়্যার:
একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার যা কম্পিউটারের হার্ডওয়্যারকে পরিচালনা করার জন্য এবং এপ্লিকেশন সফটওয়্যারগুলোকে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ প্রদানের জন্য তৈরী করা হয়েছে।
ii. প্রোগ্রামিং সফটওয়্যার:
এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম অথবা এ্যাপ্লিকেশন যা সফটওয়্যার উন্নয়নকারীরা ব্যবহার করে থাকেন কোন সফটওয়্যার তৈরী, ডিবাগ, নিয়ন্ত্রণ, রক্ষনাবেক্ষণ অথবা অন্য প্রোগ্রাম বা এপ্লিকেশনগুলোকে সহযোগিতা করতে।
iii. এপ্লিকেশন সফটওয়্যার:
এটি একটি কম্পিউটার সফটওয়্যার যেটা ব্যবহারকারীরা প্রয়োজন অনুযায়ী এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনা (এক বা একাধিক) করতে ব্যবহারকারীকে সহায়তা করে থাকে । একে শুধু এপ্লিকেশন বা এপ (App) ডাকা হয়।
মোবাইল সার্ভিসিং (Mobile Servicing)
বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রথম দিকে শুধু ধনীদের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে সেবাদানের কারণে অতি দ্রুত হারে সবার হাতেই পৌছে যাচ্ছে মুঠোফোন বা মোবাইল। ধনী-গরিব নিজেদের সাধ্যানুযায়ী মোবাইল সেট ব্যবহার করছে। মোবাইল ফোন সেটটি ব্যবহারজনিত বিভিন্ন কারণে কিংবা অসাবধানতাবশত নষ্ট হতে পারে। এজন্য ঢাকা সহ সারা দেশে কয়েক হাজার মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। যার ফলে মোবাইল ফোনের সমস্যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা অনেকটাই কমে গেছে। ধীরে ধীরে মোবাইল সার্ভিসিং একটি পৃথক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার একটি সফল উপায় হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। এসব প্রশিক্ষণ সেন্টারে মূলত যে কোন মোবাইলের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার সংক্রান্ত সব ধরনের সমস্যা এবং সমাধানের উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কোর্স গুলোকে শর্ট কোর্স, ডিপ্লোমা এবং হায়ার ডিপ্লোমারূপে বিভক্ত করে একজন প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করে। প্রতিষ্ঠানগুলো মোবাইলে ব্লু-টুথের মাধ্যমে রিং-টোন আদান-প্রদান, এমপিথ্রি, ভিডিও, ইমেজ ডাউনলোড, সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মোবাইলের আনলক, ডাটা কেবল সমস্যা এবং হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে রেজিস্টার, ক্যাপাসিটার ডায়েড ট্রান্সফর্ম, বিভিন্ন ধরনের সার্কিট ও সেগুলোর কানেকশন ডায়াগ্রাম, সিকিউরিটি কোড সহ বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান টেলিকম বাজারের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় পেশা হিসেবে মোবাইল টেকনিশিয়ানের পদটিকে মোটেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারে ৩ থেকে ১০ জন মোবাইল টেকনিশিয়ানের চাকুরির সুযোগ রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে দক্ষ মোবাইল টেকনিশিয়ানের চাকুরির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং নিয়ে যে কেউ স্বাধীন ব্যবসায় হিসেবে স্বল্প পুঁজিতে সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জীবনে সফলতা আনতে পারে। স্বাবলম্বী হতে হলে মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হয় মাত্র ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা খরচ করার মাধ্যমে। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানে মোবাইল সার্ভিসিং শিল্পের প্রসার বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন মোবাইল ফোন সার্ভিসিং শিল্পকে আরও গতিশীল করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য বেকার তরুণ ।
ফটোকপি (Photocopy)
বর্তমান যুগকে বলা হয় যান্ত্রিক যুগ। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার থিউরি অনুযায়ী অফিস আদালতের কাজ এখন আর কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে করতে হবে না বরং নির্দেশ অনুযায়ী যন্ত্রই সমস্ত কাজ করে দিবে। আজকাল তাই অফিসের দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদনে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সকল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় ফটোকপি বা ফটোস্ট্যাট যন্ত্রটি তাদের অন্যতম ।
ইংরেজি Photocopier বা Photostat শব্দে Photo শব্দের অর্থ আলোকচিত্র আর stat শব্দের অর্থ অবস্থা। অর্থাৎ ফটোস্ট্যাট শব্দ দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের আলোকচিত্রগত অবস্থাকে বুঝায়। অফিসে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের চিঠিপত্র, রেকর্ডপত্র, প্রতিবেদন, বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, দলিলপত্র, প্রমানপত্র, ক্যাশমেমো ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ব্যবহৃত ঐ সকল কাগজপত্রের হুবহু নকল কপির প্রয়োজন হয়। সুতরাং যে মেশিন বা যন্ত্র দ্বারা ব্যক্তিগত বা অফিস আদালতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কাগজ প্রত্রের হুবহু অনুলিপি আলোকচিত্রের সাহায্যে প্রস্তুত করা হয় তাকে ফটোকপিয়ার বা ফটোস্ট্যাট মেশিন বলে ।
এ মেশিনের সুবাদে আজকাল অনেক ধরনের জালিয়াতি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি অফিস আদালতের কাজ কর্মেও এসেছে গতিশীলতা। ফটোকপিয়ার যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের হুবহু প্রতিলিপি প্রস্তুত করা যায়। বিভিন্ন ধরনের ফটোকপি মেশিন বাজারে পাওয়া যায়। কিছু যন্ত্র আছে যার দ্বারা কপির সাইজ ইচ্ছামত ছোট বড় করা যায় আবার কিছু যন্ত্র আছে যার দ্বারা রঙিন ফটোকপি করা যায়। অতি সম্প্রতি জাপান স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যা ব্যবহারকারী ছাড়া নিজে- নিজেই কপির পৃষ্ঠা উল্টাতে সক্ষম।
কম্পিউটার (Computer)
আধুনিক বিজ্ঞানের সব আশ্চর্যতম আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে কম্পিউটার যা মানুষের জীবনধারাকে প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে।
আধুনিক বিশ্বে কম্পিউটারের গুরুত্ব অপরিসীম। কম্পিউটারের দ্রুত বিকাশ ও ব্যবহার সভ্যতা ও সামাজিক জীবনে নিয়ে আসছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কম্পিউটারের ব্যবহার অনেক সুফল বয়ে আনছে। উৎপাদনমুখী উন্নয়ন হচ্ছে ত্বরান্বিত, তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ঘটছে নতুন ধারার প্রবর্তন, গতিশীলতা বাড়ছে সর্বক্ষেত্রে। কম্পিউটার এখন অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও গবেষণার দেয়ালে আবদ্ধ নেই। এখন ব্যাপকভাবে গৃহকোণেও ঠাঁই নিয়েছে। কম্পিউটার ছাড়া সভ্যতার অগ্রগতি ভাবাই যায় না। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যবস্থাপনা, প্রকাশনা, শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিল্প, বিনোদন, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সমাজের সর্ব ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে কম্পিউটার ব্যবহৃত হচ্ছে ।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তিগত কাজে আর সামাজিক কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে পরেছে। যেমন ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি শেয়ার করার জন্য কম্পিউটার নির্ভর বিনোদন ব্যবস্থা, লেখালেখি করা ও যোগাযোগের জন্য সহজলভ্য ও সুলভ মাধ্যম তৈরি করে দিয়েছে কম্পিউটার। মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার, ইন্টারনেট নির্ভর চ্যাটিং ব্যবস্থা সামাজিক সম্পর্ক বিকাশের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কম্পিউটারের ব্যবহার দিন দিন এত বিস্তৃত হচ্ছে যে, ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনের যে কোন কর্মকান্ডে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
মানিগ্রাম (Money gram)
মানিগ্রাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থ স্থানান্তরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। এটি বিশ্বব্যাপি প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকদেরকে সেবা প্রদান করে থাকে। এটি প্রায় ২,৭৫,০০০ প্রতিনিধির মাধ্যমে বিশ্বের প্রায় ১৯৭ টি দেশে তার সেবা প্রদান করে থাকে । মানিগ্রামের সেবা, ব্যবসায়ীদের দক্ষ এবং অল্প ব্যয়ে ব্যবসায় পরিচালনা করতে সহায়তা করে। কোম্পানিটির ৮২% মালিকানা হচ্ছে THL এবং Goldman Sachs এর; যার মধ্যে THL এর ৫৩% এবং Goldman Sachs এর ২৯%। মানিগ্রামে বর্তমানে প্রায় ২৬০০ কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ১.১৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে। ২০১২ সালের ৯ই নভেম্বর এটি মানিলন্ডারিং আইনে স্বাক্ষর করে ।
মানিগ্রামের উল্লেখযোগ্য সেবাসমূহ:
i. মানিগ্রাম অর্থ স্থানান্তর: মানিগ্রাম বিশ্বব্যাপি থার্ড পার্টি এজেন্ট এর মাধ্যমে ভোক্তাদের অর্থ গ্রহণ ও স্থানান্তরে সহায়তা করে থাকে। ক্যাশ টু ক্যাশ ছাড়াও এটি সরাসরি ব্যাংক হিসাবে, এটিএম এর মাধ্যমে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে, কিয়োশকস (Kiosks) এর মাধ্যমে, ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে অর্থ আদান-প্রদানে সহায়তা করে থাকে।
ii. মানিগ্রাম বিল পরিশোধ সেবা: মানিগ্রাম তার বিল পরিশোধ সেবার মাধ্যমে ভোক্তাদের বিভিন্ন জরুরী বিল ও নিয়মিত বিল পরিশোধ করে থাকে। এটি বিভিন্ন ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক রাখে ।
মার্চেন্টডাইজিং (Merchandising)
যারা গার্মেন্টস ব্যবসায়ের সাথে জড়িত তাদের কাছে মার্চেন্টডাইজিং শব্দটি অতি পরিচিত। মার্চেন্টডাইজিং শব্দটি আসছে মার্চেন্টডাইজ শব্দ হতে। মার্চেন্টডাইজ শব্দের অর্থ পণ্যদ্রব্যকে বুঝায় যেগুলো কেনা বা বেচা হয়। মার্চেন্টডাইজ সেই সকল কার্যাবলীর সাথে সম্পর্কযুক্ত যা পণ্যদ্রব্য খুচরা ভোক্তাদের নিকট বিক্রয়ে অবদান রাখে। মার্চেন্টডাইজিং বলতে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে পণ্য দ্রব্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে এবং ঐ পণ্যগুলো এমন ভাবে উপস্থাপন করে যা ক্রেতাদেরকে ঐ পণ্যগুলো কিনতে উৎসাহিত করে ।
বাংলাদেশে মার্চেন্টডাইজিং ব্যবসায়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি মার্চেন্টডাইজিংকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছে।
মার্চেন্টডাইজিং এর ভূমিকা—
নিবন্ধিত, বিধিবদ্ধ দায়সম্পন্ন বৃহৎ আকারের ব্যবসায় সংগঠন কোম্পানি সংগঠন। এটি অনেকগুলো সুবিধা ভোগ করলেও বিভিন্ন দিক বিচারে এর বেশ কিছু অসুবিধাও দৃষ্ট হয়। নিম্নে এসব অসুবিধাসমূহ আলোচিত হলো:
১। গঠনে জটিলতা (Complexity in formation): বিশেষত সার্বজনীন কোম্পানি গঠন করা বেশ জটিল। এজন্য বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক ও আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর এ কোম্পানি গঠন করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এটি গঠন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।
২। অতি বৃহৎ আকার (Gigantic size): যৌথমূলধনী ব্যবসায়ের আয়তন এত বৃহৎ আকার ধারণ করে যে, এটি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়।
৩। স্বজনপ্রীতি (Nepotism): পরিচালকগণের মধ্যে উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার পরিবর্তে স্বজনপ্রীতির প্রবণতা বেশি থাকে ।
৪। মালিকানা ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছেদ Divorce between ownership ও and management): এ ধরনের কোম্পানিতে শেয়ারহোল্ডারগণ সরাসরি ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করে না। ফলে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বিচ্ছেদ দেখা দেয় ।
৫। শেয়ার বাজেয়াপ্তকরণ (Forfeiture of shares): শেয়ারের তলবী অর্থ অনাদায়ী থাকলে পরিচালকমণ্ডলী পরিমেল নিয়মাবলি অনুসারে পরিচালকমণ্ডলীর সভায় প্রস্তাব পাস করে এটি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। যেসব শেয়ার বাজেয়াপ্ত করা হয় এর প্রদত্ত অর্থ ফেরত দেয়া হয় না, ফলে শেয়ারহোল্ডরগণ বঞ্চিত হয় ।
৬। একচেটিয়া উদ্ভব (Growth of monopoly): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলো ব্যবসায় সম্প্রসারণ করতে করতে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়ায় যে, তারা তখন একচেটিয়া ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
৭। শ্রমিক শোষণ (Exploitation of workers): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতা অধিক থাকায় তারা কর্ম পরিবেশকে দূষিত করে শ্রমিক শোষণ করতে থাকে ।
৮। শ্রমিক-মালিক বিরোধ (Dispute between labour and owner): কোম্পানি পরিচালনার ভার পেশাদারি পরিচালকদের হাতে থাকায় শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে বিরোধ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে ।
৯। সমন্বয়ের অভাব (Lack of co-ordination): বৃহদায়তন কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব থাকে । ফলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন হ্রাস পায় ।
১০। সরকারি নিয়ন্ত্রণ (Government Control): বৃহদায়তন কোম্পানিগুলোর কাজকর্মের উপর সরকারি নিয়ম-কানুন আরোপ করা হয়। বস্তুতঃপক্ষে শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে, বিভিন্ন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ খুবই উপযোগী। কিন্তু সরকারি প্রশাসনে গলদ থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা হয়। ফলে কোম্পানির স্বাভাবিক কাজকর্মে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয় ।
পরিশেষে বলা যায়, যদিও এ ব্যবসায়ের অনেকগুলো অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে তবুও তুলনামূলক বিচারে এর সুবিধাই অনেক বেশি। সতর্কতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এর অনেকগুলো সীমাবদ্ধতাই দূর করা সম্ভব। তাই সকল দেশেই এটি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে ইতোমধ্যেই তার স্থান করে নিয়েছে।
আরও দেখুন...